নাম তার সামিয়া নওশিন সারা। ছোটবেলা থেকে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও সর্বোচ্চ চেষ্টায় দেশের দুইটি ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল শেষ করে নিজের ভিতরের পাইলটটাকে বের করে আনতে সবসময় মগ্ন ছিলেন সারা। কিন্তু ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হতে না পেরে যেন সারার ছোটবেলার স্বপ্ন ‘স্বপ্নই’ থেকে যায়। তবে মেধাবী ও স্বপ্নবাজ সারাকে খুঁজে নেয় দেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স।

সারার ডানা মেলে উড়ার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে নিজ খরচে পাইলটের চূড়ান্ত প্রশিক্ষণে সুদূর আমেরিকা পাঠিয়েছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। বিমান সংস্থাটির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহায়তায় মোট ২১ জন নবিশ পাইলটকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকার ফ্লোরিডায় পাঠানো হবে।

মঙ্গলবার (২ মে) প্রথম টিমে একমাত্র মেয়ে সারা ও ৯ জন ছেলেসহ মোট ১০ জনের নবিশ পাইলট টিম আমেরিকার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। নিজের সন্তান-নাতিকে ইউএস বাংলার নিজ খরচে উন্নত প্রশিক্ষণে পাঠাতে পেরে অবিভাবকরা বিমান সংস্থাটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশসহ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে প্রশিক্ষণার্থীসহ অভিভাবকরা কথা বলে তাদের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন।

সামিয়া নওশিন সারা ঢাকা পোস্টকে নিজের স্বপ্নের বিষয়ে বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে পাইলট হব। ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল শেষ করে কোভিড মহামারির কারণে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কোথাও আবেদন করতে পারিনি। তবে সামাজিক মাধ্যমে ইউএস বাংলার বিজ্ঞপ্তি দেখে নিজ স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরতে আবেদন করি। বাংলাদেশের দুইটি ফ্লাইং স্কুল থাকলেও আবেদন করার সুযোগ পাইনি। পাইলট হওয়ার পেছনে ছোটবেলা থেকেই আমার পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি। আর বর্তমানে আমার ছোটবেলার স্বপ্ন বুননের প্রথম সারথি হিসেবে ইউএস বাংলাই সুযোগ করে দিল।’ প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে দেশ তথা ইউএস বাংলার জন্য কাজ করবেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন >>> পাইলট বানাতে ২১ জনকে নিজ খরচে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে ইউএস-বাংলা

আরেকজন প্রশিক্ষণার্থী রাফিউল আলম জানান, ‘২০২০ সালে আমি নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। আমি ইউএস বাংলায় স্টুডেন্ট পাইলট হিসেবে আছি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে স্বপ্ন ছিল ডানা মেলে মুক্ত আকাশে উড়ব। আমার সেই স্বপ্নই যেন বাস্তব করে দিলো ইউএস বাংলা। আমি ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে জয়েন করার জন্য আনন্দিত। তারা আমাকে অনেকভাবে সহযোগিতা করেছে এবং আমার স্বপ্নকে পূরণ করতে তারা অংশীদার হিসেবে ছিল ও আছে। প্রশিক্ষণ শেষে আমি ইউএস বাংলায় ফিরে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করব।’

চট্টগ্রাম থেকে আসা আরেক স্টুডেন্ট পাইলট উমায়ের ইবনে হকও ১০ জনের টিমে আমেরিকা যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘বাংলাদেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি এখন অনেক বড় হচ্ছে এবং ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সও অনেক সমৃদ্ধ হচ্ছে। ইউএস বাংলার পরিকল্পনা অনুযায়ী উদ্যোগটা খুবই ভালো। ইউএস বাংলার নিজস্ব আর্থিক সহায়তায় পাইলটদের মেধার ভিত্তিতে বাইরের দেশে ট্রেনিং করানো অনেক বড় একটা ইনিশিয়েটিভ। এটা শুধু কোম্পানির জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য কাজ করছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। সেই সঙ্গে এটা নতুন ক্যাডেট পাইলটদের জন্যও বিশাল বড় একটা বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘আমার ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল পাইলট হওয়ার। এ পেশা নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে এবং নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণ করা যাবে। ইউএস বাংলা আমাকে এ সুযোগটা দিয়েছে। এজন্য আমি ইউএস বাংলার প্রতি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ যে, তারা নিজের ফান্ডিংয়ে আমাকে আমেরিকার মতো দেশে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাচ্ছে। আমাদের ভিসা থেকে শুরু করে বিমানের টিকিটসহ সব খরচ ইউএস বাংলা বহন করছে।’

এক অভিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বড় হয়ে কি হবে, ছোটবেলায় আমার বাচ্চাকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে বলত আমি পাইলট হব। আমার সন্তান এইচএসসি পাশ করে এ সার্কুলারটা পেয়ে আমার অনুমতি নিয়ে আবেদন করে। আবেদন করার পর আল্লাহর রহমতে আমার সন্তান টিকেও গেল। আমি ইউএস বাংলাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। কারণ, বাংলাদেশের মধ্যে ইউএস বাংলাই এ ধরনের প্রথম উদ্যোগ নিল। আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ। নিজেদের টাকায় হলে তো আমরা এ কাজটা করতে পারতাম না। কিন্তু সেই কঠিন কাজটা ইউএস বাংলা করে দিলো। এজন্য আমি ইউএস বাংলা নিকট ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার প্রত্যাশা থাকবে, ওরা যেন ভালোভাবে ট্রেনিং শেষ করে বিজয়ের বেশে দেশে ফিরে আসে। ওরা ভালো করলে ইউএস বাংলা আরও উদ্যোগ নিতে পারবে।’

আরেক অভিভাবক মো. আনোরুজ্জামান নাতিকে বিদায় দিতে এসেছেন খুলনা থেকে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইউএস বাংলা এ মুহূর্তে একটি দারুণ উদ্যোগ নিয়েছে। এটা বাংলাদেশ তথা নতুন পাইলট হিসেবে যারা নিযুক্ত হয়েছেন, তারা সবাই গর্বিত। ইউএস বাংলার মাধ্যমে তারা সবাই যেন ভালো বৈমানিক হয়ে দেশে ফিরে আসতে পারেন। এতে করে এ প্রতিষ্ঠানটির সুনাম অর্জিত হবে এবং দেশেরও সমৃদ্ধ অর্জিত হবে। আমি ইউএস বাংলার এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।’ 

আরও পড়ুন >>> বিশ্বমানের পাইলট তৈরিতে ইউএস বাংলার সাহসী উদ্যোগ

ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ইউএস বাংলা আজ যে উদ্যোগটা নিয়েছে, এটা আসলে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই নিয়েছে। ইউএস বাংলা গত ১০ বছর ধরে অপারেশন্সে আছে। ২০১৪ সালে মাত্র দুইটি এয়ারক্রাফট নিয়ে শুরু করে বর্তমানে এর বহরে ১৯টি এয়ারক্রাফট আছে। বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার ৫০০ জনবল কাজ করছেন। এর মধ্যে ১৯০ জনের অধিক দেশি এবং বিদেশি পাইলট আছে। বর্তমানে আমাদের ইউএস বাংলার যেভাবে এক্সপানশন হচ্ছে, সেভাবে পাইলটেরও চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বর্তমান সময়ে সারাবিশ্বে আমরা পাইলটের ক্রাইসিস দেখতে পাচ্ছি। সেই ক্রাইসিসটা দূর করার জন্যই ইউএস বাংলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহায়তা নিয়ে সাড়ে ৬ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে বাছাই করে ২১ জন পাইলট চূড়ান্ত করেছি। আমরা তাদের দেশে রান কোর্স শেষ করে আমেরিকার ফ্লোরিডাতে ফ্লাইং কোর্সের জন্য পাঠাচ্ছি আজ। ওখানে প্রশিক্ষণ শেষে পাইলটের লাইসেন্স নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে তারা ইউএস বাংলাতে জয়েন করবে। পাইলটদের এ প্রশিক্ষণের বিষয়টি আমাদের চলমান থাকবে। চলতি বছর আমাদের বহরে আরও ৪টি এয়ারক্রাফট যোগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’

কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আজ আমরা পাইলট দিয়ে শুরু করলেও আগামীতে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টর থেকেও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর পরিকল্পনা আছে। সবকিছু মিলিয়ে এভিয়েশনটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স সব ধরনের এক্টিভিটিস নিয়ে কাজ করছে। দক্ষ জনশক্তি ছাড়া এভিয়েশনের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেজন্যই আমরা প্রশিক্ষণ নিতে পাইলটদের বিদেশে পাঠিয়েছি।’

এসআর/এফকে