আজ থেকে সাড়ে ৫ বছর আগে (১২ জুলাই ২০১৬) একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ‘আমাদের পৃথিবীটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন। একেক জন একেক ব্যাখ্যা দেবেন হয়তো কলামের শিরোনাম দেখে। একজন এভিয়েশন কর্মী হিসেবে সাবেক সচিব মহোদয়ের শিরোনামের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যাচ্ছে আমাদের আকাশ পরিবহনের বর্তমান অবস্থা। সারাবিশ্বের আকাশ পরিবহন যেখানে দূর দিগন্ত খুঁজে নিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের আকাশ পরিবহন যেন ততটাই স্তিমিত হয়ে আসছে। 

লাল সবুজের পতাকা-বেষ্টিত আমাদের বাংলাদেশ সৃষ্টির মাত্র ১৮ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জানুয়ারি জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গঠন করেন। ৫০ বছর অতিক্রম করেছে আমাদের বিমান সংস্থা। বিশ্বের ৪২ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এয়ার সার্ভিস এগ্রিমেন্ট রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অদম্য ইচ্ছায় বিমানের বহরে যোগ করেছেন ৪র্থ জেনারেশনের অনেকগুলো আধুনিক উড়োজাহাজ। বর্তমানে বিমানের বহরে রয়েছে ২১ উড়োজাহাজ, যার অধিকাংশই নতুন। গত শতাব্দীর নব্বই দশকেও ২০টির বেশি দেশে ২৮ থেকে ২৯ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালিত হতো। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে ধীরে ধীরে আকাশপথ ছোট হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন : বিশ্ব এভিয়েশন : প্রি-কোভিড, কোভিড ও কোভিড পরবর্তী চ্যালেঞ্জ 

বর্তমানে ১২টি দেশের ১৮টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে জাতীয় বিমান সংস্থা। নতুন পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে আরও বেশ কিছু ফ্লাইট নিয়ে পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ বিমানের প্রতিষ্ঠাকালীন কিংবা তারও অনেক পরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের বেশ কিছু বিমানসংস্থা সারাবিশ্বের আকাশপথে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, থাই এয়ারওয়েজ প্রমুখ। 

বিশ্বের প্রায় সব দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীরা জীবিকার প্রয়োজনে বসবাস করছে। বাংলাদেশি যাত্রীদের বহন করে বিশ্বের অনেক এয়ারলাইন্স ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশি এয়ারলাইন্স হিসেবে আমাদের যাত্রীদের আমরা নিজেরাই বহন করতে পারছি না। আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৭০ ভাগই বিদেশি বিমানসংস্থার দখলে। সেখানে বাংলাদেশি বিমানসংস্থা হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স অবশিষ্ট ৩০ ভাগ মার্কেট শেয়ার নিতে পারছে।

আরও পড়ুন : প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলোকে

বেসরকারি বিমান পরিবহনেরও প্রায় দু’যুগ কেটে গেছে। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের সময়কাল। ৭ থেকে ৮টি বেসরকারি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স  আলোর দিশারি হয়ে পথ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ পা ফসকে যাওয়ার মতো অবস্থা! জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের মতো দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব আকাশ পরিবহনে এগিয়ে যাওয়ার যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পরিশেষে লাইন-চ্যুতি হতে দেখেছি। 

নয় বছর অতিক্রম করেছে নভোএয়ার। এখনও অনেকটা অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অপারেশনে থাকা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সর্বকনিষ্ঠ বেসরকারি বিমান সংস্থা। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে যশোরে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। দুই বছরের মধ্যেই ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রা শুরু করে। এরপর আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর অতীত অভিজ্ঞতালব্ধ হয়ে এবং বিশ্ব এভিয়েশনের চলার পথে নানা অনুকূল প্রতিকূল সব পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করে ইউএস-বাংলা এগিয়ে যাচ্ছে। 

প্রায় ৮ বছরে ২টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট থেকে ছয়টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটসহ মোট ১৬টি এয়ারক্রাফট নিয়ে বহরকে সমৃদ্ধ করেছে। ঢাকা থেকে যশোর রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মধ্য দিয়ে শুরু করা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স অভ্যন্তরীণ সব রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ২০১৬ সালের ১৫ মে এর পর ৯টি দেশের ১১টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খুব শিগগিরই ঢাকা থেকে কলম্বো, দিল্লী, জেদ্দা, রিয়াদ, মদিনা, দাম্মাম রুটে ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশীয় এয়ারলাইন্স হিসেবে ইউএস-বাংলা বিদেশি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইউএস-বাংলার প্রতিযোগী এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে বিদেশি এয়ারলাইন্স এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, ফ্লাই দুবাই, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, স্পাইস জেট, ইনডিগো, ওমান এয়ার, এয়ার এশিয়া, মালিন্দোসহ বিশ্বের সব নামীদামী সব এয়ারলাইন্স। 

আরও পড়ুন : বিশ্বের ট্রাভেল ও পর্যটনকে হাতের মুঠোয় এনেছে ওটিএ

বাংলাদেশের এভিয়েশন ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে ইউএস-বাংলাই একমাত্র এয়ারলাইন্স ৯টি দেশের ১১টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আগামী  দু’বছরের মধ্যে ইউরোপের যেসব দেশগুলোতে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বসবাস করছেন সেসব দেশে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিউইয়র্ক, টরোন্টো যাওয়ার পরিকল্পনাও আছে ইউএস-বাংলার।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় পনের মিলিয়ন বাংলাদেশি বসবাস করছে। এছাড়া গত প্রায় দশ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশীয় পর্যটকরা ভ্রমণ করছে। বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতার জন্য বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশের মার্কেট দখল করে আছে। ইউএস-বাংলা চাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের সেবা ও আধুনিক উড়োজাহাজ ব্যবহার করে এদেশের যাত্রীদের প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যেতে। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হবে দেশ, উপকৃত হবে বাংলাদেশ এভিয়েশন মার্কেট। নতুন নতুন আকাশপথের দুয়ার উন্মোচন ঘটবে। কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে, বেকার সমস্যা দূরীকরণে বড় ভূমিকা রাখবে। দেশের জিডিপি-তে অন্যান্য খাতের মতো ভূমিকা রাখবে।

আরও দুটি  নতুন এয়ারলাইন্সের অনুমতি দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে দেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর পাশে সরকারের সহযোগিতার হাত অধিকতর প্রসারিত করা প্রয়োজন। যাতে করে দেশের এয়ারলাইন্সগুলো এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সাজাতে পারে। 

পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের যে সোপান নিয়ে ইউএস-বাংলা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে দৃঢ়চিত্তে বলা যায় ছোট পৃথিবীকে বড় করার পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি বিমান সংস্থাটি।             

লেখক : মহাব্যবস্থাপক- ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স