দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো আবারো খাবারের প্লেটে তুলে আনার লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। ইতোমধ্যে ৩১ প্রজাতির দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। যার মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে দারকিনা মাছ। সম্প্রতি অধিক পুষ্টিসম্পন্ন ছোট্ট এই মাছটির কৃত্রিম প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। 

গত মার্চে বিএফআরআই স্বাদু পানি কেন্দ্রে এ সফলতা অর্জিত হয়। গবেষক দলে ছিলেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী।

বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, দেশীয় প্রজাতির দারকিনা মাছটি দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতের আসাম ও গাঙ্গেয় প্রদেশ, মায়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মাছটিকে স্থানীয়ভাবে ডাইরকা, ডানখিনা, দাড়কিনা, ডানকানা, দারকি, দারকা, চুক্কনি, দাইড়কা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এক সময়ের বহুল পরিচিত ও সুস্বাদু এ মাছটি এখন বিলুপ্তির পথে। এ মাছের পুষ্টিগুণ অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছে ভিটামিন-এ ৬৬০ মাইক্রোগ্রাম আরএই, ক্যালসিয়াম ৮৯১ মিলিগ্রাম, আয়রণ ১২ দশমিক শূন্য মিলিগ্রাম এবং জিংক ৪ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়।

এক সময় দেশের যেকোনো জলাশয় বিশেষ করে খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে দারকিনা মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় মাছটির প্রাপ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে এ মাছটি বাংলাদেশে বিপন্নের তালিকায়। বাজারে কখনও পাওয়া গেলেও বিক্রি করা হয় ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে। মাছটির জিনপুল সংরক্ষণের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কলা-কৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদু পানি কেন্দ্রে গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দারকিনা মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, দারকিনা মাছ প্রধানত ছোট ছোট প্লাংকটন, পোকামাকড়, শেওলা এবং জলজ কীটপতঙ্গ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ মাছের প্রজননকাল মার্চ থেকে শুরু হয়ে জুলাই মাস পর্যন্ত হলেও মে-জুলাই এদের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। 

পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী দারকিনা মাছ অপেক্ষাকৃত আকারে বড় হয়। মার্চ মাসে স্ত্রী মাছের জিএসআই ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ডিম ধারণ ক্ষমতা ২২০০-৩২৫০ (দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৪ সেন্টিমিটার এবং দেহ ওজন ১ দশমিক ৫-২ ধমমিক ০ গ্রাম)। প্রতি গ্রাম স্ত্রী মাছে গড়ে ৯০০-১০০০টি ডিম পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাছের ডিম্বাশয় মার্চ মাস থেকে পরিপক্ক হতে শুরু করে।

বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, এই মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য গত মার্চ মাসের শেষ দিকে পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করে পুকুর থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ক স্ত্রী মাছের পেট ফোলা ও নরম দেখে শনাক্ত করা হয়। পরিপক্ক স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রীয় গোলাকার ও ফোলা হয় কিন্তু পুরুষ মাছের জননেন্দ্রীয় পেটের সঙ্গে মেশানো, লম্বাটে ও ছোট হয়।

কৃত্রিম প্রজননের ৫-৬ ঘণ্টা পূর্বে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ (১ দশমকি ৫-৩ গ্রাম) পুকুর থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারির সিস্টার্নে রাখা হয়। এরপর কৃত্রিম প্রজননের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ দারকিনা মাছকে পিজি হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। ইনজেকশন দেওয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ১ অনুপাত ১ দশমিক ৫ অনুপাতে সিস্টার্নে স্থাপিত নটলেস হাঁপায় রাখা হয় এবং অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ঝর্ণার মাধ্যমে পানির প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়।

ইনজেকশন দেওয়ার ৬-৭ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম দেয়। এ মাছের ডিম আঠালো প্রকৃতির না হওয়ায় হাঁপার নিচের দিকে লেগে থাকে। ডিম দেওয়ার পর ব্রুড মাছকে হাঁপা থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হয়। ডিম দেওয়ার ১৪-১৬ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে। ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর হাঁপাতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা রাখতে হয়।

হাঁপা থেকে ডিমের খোসা ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ প্লাষ্টিকের পাইপ দিয়ে সাইফনিং করে সরিয়ে ফেলতে হয়। রেণুর ডিম্বথলি ৬০-৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার পর প্রতিদিন ৩-৪ বার মুরগির সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে হাঁপায় সরবরাহ করা হয়। হাঁপাতে রেণু পোনাকে এভাবে ২-৩ দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। 

পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮-০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন হওয়ায় ২০২০-২১ সালে উৎপাদন ৪ গুণ বেড়ে আড়াই লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় সব মাছকে পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের আওতায় চলতি বছর প্রথম সুস্বাদু দারকিনা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জিত হয়েছে। চলতি বছর আরও আটটি দেশীয় মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে দেশীয় মাছ চাষাবাদে পোনা প্রাপ্তি সহজতর হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। গবেষণার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সব দেশীয় মাছকে খাবারের প্লেটে ফিরিয়ে আনা হবে। এ লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর/এসপি