জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বিশেষায়িত বিভিন্ন বিভাগে (সংগীত, নাট্যকলা, চারুকলা) শ্রেণিকক্ষের সংকট দেখা দিয়েছে। আছে পর্যাপ্ত শিক্ষকেরও অভাব। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, শ্রেণিকক্ষের সংকট সমাধানে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কক্ষ বরাদ্দের বিষয়টি দেখভাল করছে।

শিক্ষক সংকটের বিষয়ে তারা বলছে, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কী করলে শিক্ষক সংকট থাকবে না, সেজন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর্যাপ্ত স্থান সংকুলান হচ্ছে না নাট্যকলা বিভাগে। একাধিক শিক্ষার্থী এমন অভিযোগ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস বেশি। কম স্পেসে ক্লাস করতে সমস্যা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সমস্যা চলছে
শ্রেণিকক্ষের সংকটে ব্যাহত হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত সংগীত, নাট্যকলা ও চারুকলা বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম / ঢাকা পোস্ট

চারুকলা বিভাগ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারুকলা বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্র্যাকটিক্যাল (পেইন্টিং) কাজ বেশি করতে হয়। পাঠদানের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেগুলো তুলনামূলক ছোট। গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয়। এছাড়া একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভালো মানের একটি স্টুডিও দরকার। সেটিও নেই। কোনো রকম দায়সারা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চারুকলা বিভাগের জন্য (তিনটি ডিসিপ্লিন) বরাদ্দ আছে মোট ছয়টি শ্রেণিকক্ষ। প্রতিটি ব্যাচে ৪০ জন করে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী ক্লাস করেন। ২০১৩ সালে পেইন্টিং, প্রিন্ট মেকিং ও স্কাল্পচার নামে আলাদা আলাদা তিনটি ডিসিপ্লিন নিয়ে চারুকলা বিভাগ গঠন করা হয়।

শ্রেণিকক্ষ সংকটের বিষয়ে চারুকলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বজলুর রশিদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রেণিকক্ষ সংকটের বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি। বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ আন্তরিক। প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে, তবে বরাদ্দ দেওয়া কক্ষগুলো এখনও তারা হস্তান্তর করেনি।

পাঠদানের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেগুলো তুলনামূলক ছোট। গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয়। এছাড়া একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভালো মানের একটি স্টুডিও দরকার। সেটিও নেই। কোনো রকম দায়সারা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
পাঠদানের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেগুলো তুলনামূলক ছোট— অভিযোগ চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের / ঢাকা পোস্ট

‘স্টুডিওভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করতে হয় আমাদের। এ কারণে ভালোমানের একটি স্টুডিও প্রয়োজন। আমাদের ৮০ শতাংশ প্র্যাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) এবং ২০ শতাংশ থিওরিটিক্যাল (তাত্ত্বিক) ক্লাস। প্র্যাকটিক্যালের জন্য ছয়টি কক্ষ আছে। থিওরিটিক্যাল ক্লাসের জন্য কোনো রুম (শ্রেণিকক্ষ) নেই। একটি ক্লাসরুম হলে আপাতত এ সংকটের সমাধান সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এ বিভাগে মোট ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন। আরও ২০ জন শিক্ষক প্রয়োজন। গ্রাফিক ডিজাইনে মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন। এ বিষয়ে (গ্রাফিক ডিজাইন) আলাদা বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে চারুকলা অনুষদ (পেইন্টিং, প্রিন্ট মেকিং, স্কাল্পচার ও গ্রাফিক ডিজাইন) নামে নতুন অনুষদ খোলার প্রস্তাব পাস হয়। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে পাঠানো হয়েছে, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন— বলেন অধ্যাপক ড. বজলুর রশিদ খান।

জরাজীর্ণ কক্ষে ব্যবহারিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের / ঢাকা পোস্ট

সংগীত বিভাগ

পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের সংকট রয়েছে সংগীত বিভাগেও। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক ড. আলী এফ এম রেজোয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে আমাদের শ্রেণিকক্ষের সংকট। এখনও সমাধান হয়নি। শ্রেণিকক্ষ নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেছি। কবে কক্ষ বরাদ্দ দেবে— এখনও জানানো হয়নি।

ব্যবহারিক বিষয়ে আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। পর্যাপ্ত কক্ষ না থাকায় ঠিক মতো ক্লাস ও পরীক্ষা নিতে সমস্যা হয়— বলেন এ শিক্ষক।

সংগীত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ সেশনের (স্নাতকোত্তর) ২৯ শিক্ষার্থী এবং স্নাতক ২০১৬-১৭ সেশনের ২৪ জন, ২০১৭-১৮ সেশনের ২৮ জন, ২০১৮-১৯ সেশনের ৩০ জন, ২০২০-২১ সেশনের ৪৫ জনসহ মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭০ জন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংগীত বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরাতন ভবনে অনেক কষ্টে ক্লাস করতে হচ্ছে। যেহেতু ব্যবহারিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, এ কারণে প্রচুর জায়গা লাগে। শুনেছি নতুন একাডেমিক ভবনের ১২ তলায় আমাদের জন্য স্থান-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানেও পর্যাপ্ত জায়গা নেই বলে মত দেন শিক্ষার্থীরা।

শুধু শ্রেণিকক্ষ নয়, শিক্ষক সংকটও দেখা দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত সংগীত, নাট্যকলা ও চারুকলা বিভাগে / ঢাকা পোস্ট  

এ বিভাগের শিক্ষার্থী প্রত্যাশা রায় বলেন, শুরু থেকেই আমাদের কক্ষ সংকট। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউটিলিটি ভবনে আমাদের বিভাগ ছিল। সেখান থেকে নতুন একাডেমিক ভবনের ১২ তলায় বিভাগ স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এখানেও একই অবস্থা। যদিও একটি বড় কক্ষ দিয়েছে।

সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক ড. ঝুমুর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৩ সালে সংকটের মধ্য দিয়েই আমাদের যাত্রা। শিক্ষকদের বসার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এখন নতুন চারটি কক্ষ পেয়েছি। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি বড় শ্রেণিকক্ষ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থী অনুপাতে আমাদের মোট ৪২ শিক্ষক দরকার। আছেন মাত্র নয়জন। জরুরিভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

পুরাতন ভবনে অনেক কষ্টে ক্লাস করতে হচ্ছে। যেহেতু ব্যবহারিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, এ কারণে প্রচুর জায়গা লাগে। শুনেছি নতুন একাডেমিক ভবনের ১২ তলায় আমাদের জন্য স্থান-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানেও পর্যাপ্ত জায়গা নেই বলে মত দেন শিক্ষার্থীরা
শ্রেণিকক্ষের সংকট আগে ছিল, এখন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবস্থা তাতে সংকট একটু থাকবেই— জবির কক্ষ বরাদ্দ কমিটির আহ্বায়ক কামালউদ্দীন আহমেদ / ঢাকা পোস্ট

নাট্যকলা বিভাগ

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর্যাপ্ত স্থান সংকুলান হচ্ছে না নাট্যকলা বিভাগে। একাধিক শিক্ষার্থী এমন অভিযোগ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস বেশি। কম স্পেসে ক্লাস করতে সমস্যা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সমস্যা চলছে।

নাট্যকলা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে এখানে মোট শিক্ষার্থী ২০৬ জন। শিক্ষক আছেন আটজন। আরও পাঁচ/ছয়জন শিক্ষক প্রয়োজন। আগে দুটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হতো। এখন নতুন কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান শামস শাহরিয়ার কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্টুডিও থিয়েটার বা ল্যাব কক্ষ, এক্সপেরিমেন্টাল হল দরকার। কিন্তু আমাদের তা নেই। শিক্ষকদের বসার জন্য রয়েছে কক্ষের সংকট। ইসলামিক স্টাডিজের ভাষা শহীদ রফিক ভবনে একটি কক্ষ আছে। সেটি আমাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শ্রেণিকক্ষও বরাদ্দ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু এখনও হস্তান্তর করা হয়নি। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে হস্তান্তর করা হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেস বা কক্ষ বরাদ্দ কমিটির আহ্বায়ক ও ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমেদ বলেন, সমস্যা সমাধানে কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। শ্রেণিকক্ষের সংকট আগে ছিল, এখন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবস্থা তাতে সংকট একটু থাকবেই।

শ্রেণিকক্ষের সংকটের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা একটি স্পেস বরাদ্দ কমিটি করেছি। তারা বিষয়টি দেখছে। আগে তো এ সমস্যা সমাধানে কোনো কমিটিই ছিল না।

সংকট থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা না করে কেন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বিভাগগুলোকে আসন সংখ্যা যৌক্তিকভাবে কমানো বা বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছি। বিভাগগুলো এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।

শিক্ষক সংকটের বিষয়ে উপাচার্য ইমদাদুল হক বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কী করলে শিক্ষক সংকট থাকবে না, সেজন্য বিভাগগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এমটি/এমএআর/