ছবিতে ঢাবি শিক্ষার্থী এবং তার মা

বাবার অবর্তমানে সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে চা শ্রমিক মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের কথা তুলে ধরে ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এক শিক্ষার্থীর আবেগঘন স্ট্যাটাস মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে।

মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা বাগানের এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম সন্তোষ রবিদাস অঞ্জনের। জন্মের মাস ছয়েকের মাথায় বাবাকে হারিয়েছিলেন। সন্তানকে মানুষ করতে মা কমলি রবিদাস বৃদ্ধা বয়সেও চা বাগানে কাজ করেন। পরিবারে অঞ্জনের মা ছাড়া আর কেউ নেই।

আরও পড়ুন: অষ্টম দিনের মতো চলছে চা-শ্রমিকদের কর্মবিরতি

সম্প্রতি চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মায়ের দুঃখ-দুর্দশার কথা ফেসবুকে লেখেন সন্তোষ রবি দাস অঞ্জন।

চা-বাগানের দৈনিক ১৮ টাকা বেতনে কাজ শুরু করা ইতিহাস তুলে ধরে অঞ্জন লেখেন, ‘সেই সময় আমাকে পটের দুধ খাইয়ে, অন্যের বাসায় রেখে মা যেতেন বাগানে কাজ করতে। ২০০৭ সালে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। মায়ের মজুরি তখন ৮৮ টাকা। এক দিন বললেন, ‘বাজারে গিয়ে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে আয়।’ সেই চাল দিয়ে এক মাস চলেছে আমাদের। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি মা চাল ভাজলেন। পলিথিনে সেই ভাজা চাল, আটার রুটি আর লাল চা একটা বোতলে ভরে গামছায় প্যাঁচালেন। আর আমাকে আটার রুটি ও লাল চা দিলেন। দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি শুধু পেঁয়াজ, শুকনা ভাত, তেল আর লবণ আছে। তা দিয়ে মেখে খেলাম। রাতেও কোনো তরকারি ছিল না। তখন পাশের বাসার কাকু আমাকে ডেকে কুমড়া আর আলু দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা দুইটা দিন পার করেছিলাম। তখন কুপি বাতির আলোয় পড়তাম। মা আগেই রেডি করে দিতেন বাতি। তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া হতো না। দোকানদার বাকিতে তেল দিতেন না।’

তিনি লিখেন, ‘পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রি পড়ালেখার সুযোগ পাই। মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। তখন তাঁর সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা দিতেন। ২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হই। তখন মা ১০২ টাকা করে পেতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিস্তি তুলে আমার ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন। ২০১৪ ডিসেম্বর। মায়ের হাতে টাকা নেই। তখন এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন চলছিল। মা ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, ‘কেউ ধার দেয়নি রে বাপ’। কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলাম।’

‘এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। মা তখন আবার লোন নিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। লোনের কিস্তির জন্য এই সময় মা বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বিনিময়ে পেতেন ৩০০ টাকা। আমি জানতাম ঘরে চাল নেই। শুধু আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়েছিলেন মা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন! কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। কারণ চা-বাগানে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে। পরে এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতাম। হলের ক্যান্টিনে ২০ টাকার সবজি-ভাত খেয়েই দিন পার করেছি। অনেক দিন সকালে টাকার অভাবে নাশতাও করতে পারিনি। দুর্গাপূজায় কখনো একটা নতুন জামা কিনতে পারিনি।’

মা বলেছিলেন তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে! মা এখনো প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতি তোলার গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ান চা-বাগানে। আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পান! এই মজুরিতে কিভাবে চলে একজন শ্রমিকের সংসার? আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। বলেন, ‘তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব।’ আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি।’

এদিকে স্ট্যাটাসটি নজরে আসলে অনেকেই তাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছেন। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্কমর্তার মাধ্যমে রোববার প্রশাসক কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে কীসের চাকরি দেবেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন তিনি। এছাড়া আবুল খায়ের গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, ম্যাক্সমন গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাকে চাকরি প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, এসএম জাকির হোসাইন, গোলাম রব্বানীও ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বায়োডাটা নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, আমার স্ট্যাটাসটি দেখে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করতে আমি আগ্রহী। মা কষ্ট করে বড় করছেন, সরকারি চাকরি পেলে তিনি খুশি হবেন। সেজন্য স্নাতকোত্তর শেষ করার পর বিসিএসসহ বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছি। প্রাইমারি পরীক্ষায় লিখিততে উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছি। কিন্তু কোনোটারই ফল প্রকাশ হয়নি।

এইচআর/এমএ