চারুলতা বিদ্যাপীঠ

একটি পরিত্যক্ত চায়ের দোকান সংস্কার করে মাত্র ২০ জন বস্তিবাসী শিশুকে নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু। শুধু শিক্ষা নয়, তাদের চিকিৎসা, শিক্ষাপোকরণ, ঈদের নতুন জামা, শীতের দিনে উষ্ণতা দিতে শীতবস্ত্র, নাচ, গান, আব়ত্তি, ছবি আঁকার মতো সহপাঠ্যক্রমিক নানা আয়োজনে বস্তির শিশুদের শিক্ষামুখী করতে কাজ করছে চারুলতা বিদ্যাপীঠ। চট্টগ্রাম শহরের ২ নম্বর গেটে তুলাতলী বস্তিতে চলে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমদাদ হোসেন (বর্তমানে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার), এস এম অভিক চৌধুরী (বর্তমানে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সবুজ মন্ডল, মেরিন ফিশারিজ বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সালাউদ্দিন রাশেদ, লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সৌমেন নন্দী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজেন দে।

এই ছয় বন্ধু আড্ডা দিতেন চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে। সেখান থেকেই তারা অনুভব করেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগাদা। প্রথম দিকে দুর্যোগের সময় ত্রাণ, শীতবস্ত্র আরও কিছু বিচ্ছিন্ন কাজে যুক্ত থাকলেও একসময় সেটা বস্তিবাসী, ছিন্নমূল মানুষের ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার কাজে যুক্ত করার প্রেরণা জোগায় তাদের। 

‘সুপ্ত সত্তায় প্রাণের সঞ্চারণ’― এমন ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে যাত্রা শুরু করে চারুলতা। এরও আগে বিচ্ছিন্নভাবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য কিছু একটু করার চেষ্টা করত তারা। সে সময় তাদের কিছু লক্ষ্য থাকলেও, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত শিক্ষার আলো ছাড়া মানব আত্মার মুক্তি সম্ভব নয়। 

তাই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মানবিক তাড়না থেকে ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে 'চারুলতা' নামের একটি সংগঠন। এক বছর পর একই দিনে অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল রূপ পায় 'চারুলতা বিদ্যাপীঠ'।

শুরুর দিকে ভাড়ায় নেওয়া চা দোকানটায় শিক্ষার্থীসংখ্যা মাত্র ২০ হলেও বর্তমানে চারুলতায় পড়ছে দেড় শতাধিক শিশু। সবে অক্ষরজ্ঞান পেতে শুরু করা কুঁড়িগুলো বছরের ব্যবধানে এখন নবম শ্রেণিতে উঠেছে।

এ বিদ্যাপীঠে পড়ানো হয় শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শেষে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হলে তাদের সব খরচও বহন করে চারুলতা। ঝরে পড়া রুখতে এসব শিক্ষার্থীর জন্য বৈকালিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। আর শ্রেণি কার্যক্রম চলে প্রতিদিন দুপুর দুইটা থেকে দুই শিফটে ভাগ করে।

সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ডা. ইমদাদ হোসেন বলেন, আমরা চিন্তা করেছি এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ না করে, প্রতিষ্ঠিত ও সমাজের জন্য কার্যকর কিছু একটা করতে, যেন একেবারেই যাদের সক্ষমতা নেই, তাদের জন্য স্থায়ী কিছু করতে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন আমাদের এ স্কুলটা দাঁড়িয়েছে, নগরীতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আরও কিছু এমন স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছি। দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে এসব শিশু ঝরে পড়ে। তারা যেন শিক্ষা থেকে ছিটকে না পড়ে, সে জন্য তাদের হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে বিকেলে প্রাইভেটের মতো করে পড়াই। তাদের খরচটা আমরাই বহন করব। যারা একান্তই পড়তে আগ্রহী না, তাদের জন্য ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি।

চারুলতার বর্তমান সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮০। আর আয়ের মূল উৎস সদস্যদের কাছে পাওয়া মাসিক চাঁদা। পাশাপাশি শুভাকাঙ্ক্ষী আর উপদেষ্টাদের দেওয়া মাসিক চাঁদার টাকায় চলে এ বিদ্যালয়।

চারুলতা বিদ্যাপীঠ থেকে ২০১৮ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ১০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখান থেকে এক শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো এ প্লাস পায়। বাকি ৯ জন পেয়েছিল এ গ্রেড। সে ফলাফল তুলাতলি বস্তিতে আনন্দের বন্যা বয়ে দিয়েছিল। আর ২০১৯ সালে ১০ জনে ৮ জন পায় এ গ্রেড। কিন্তু ২০২০ সালে অতিমারি করোনার কারণে পরীক্ষায় বসতে পারেনি চারুলতার শিক্ষার্থীরা।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অমি দে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বস্তিবাসী শিশুদের পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় পরিবার থেকে তাদের পড়াশোনার খরচ বহন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যেমনটা সচরাচর আমরা দেখি, খুব কম বয়সে তাদের শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজে দিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার আলো না পৌঁছানোর কারণে অবিভাবকরা তাদের কাজে দিয়ে সংসারে আয় বাড়ানো টাই তাদের গন্তব্য হয়ে ওঠে। শিক্ষাসুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো এসব সম্ভাবনাময় শিশুও। চারুলতার কল্যাণে এখন তারা শিক্ষাসুবিধা পাচ্ছে।

অমি দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি আরও বলেন, এখন পুরো এলাকায় অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক বিষয়গুলোয় সচেতনতা লক্ষ করা যায়। পড়ানোর পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষার গুরুত্ব, নারী শিক্ষার গুরুত্ব, বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব― এসব ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করি আমরা।

এখানকার শিক্ষকরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, চুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যারা চারুলতার সদস্য, তারাই স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষা দেন এখানে।

এনএ