ফাইল ছবি

আগামী ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছে। অন্যদিকে ক্ষমতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে বাংলাদেশের আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ফলে বহু কাঙ্ক্ষিত এ নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা জড়িয়েছেন তর্কে। তা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে রাজপথে। মাঠে-ময়দানে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা।

এরই মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন বিএনপির ৭ নেতাকর্মী। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারো নেতাকর্মী। এই পরিস্থিতিতে কান পাতলে শোনা যায় নানা গুজব। এসব গুজব কখনো কখনো স্বয়ং সরকারি দল ব্যবহার করছে আবার কখনো কখনো অন্যরা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আগামী নির্বাচনে সুশাসন তথা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় গুজব কি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে?

বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্বাচনগুলোতে গুজব অন্যতম একটি হাতিয়ার। গুজবকে ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার ইতিহাসও কম নয়। এর আগে বাংলাদেশে অনলাইনে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়িয়ে হামলা কিংবা উত্তেজনা সৃষ্টির বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা ঘটেছে। এমন অবস্থায় আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে ভুয়া খবর ছড়িয়ে সুবিধা নেওয়ার বা সহিংসতা সৃষ্টির প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব ভুয়া প্রচারণার পেছনে উদ্দেশ্য হলো পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সহিংসতা উস্কে দেওয়া কিংবা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা।

সম্প্রতি মজিলা ফাউন্ডেশনের ফেলো ওডাঙ্গা মাদুং তার নেতৃত্বে নির্বাচনে গুজবের ব্যবহার নিয়ে এক গবেষণা চালায়। এতে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে ফেসবুক, টিকটক ও টুইটারের মতো নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ পায় তারা। উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে এসব গুজব ছড়ানো হয়েছে বলে তারা দাবি করেন।

এ বছরের ৯ আগস্ট কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় ও পরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্য লুকিয়ে, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানোর প্রচুর প্রমাণ উল্লেখ করে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়েছিল, আরও কত ভয়াবহ হতে পারত, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কেনিয়ার নির্বাচনে সহিংসতায় মোট ২৪ জনের প্রাণহানি হয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। গবেষক দল উল্লেখ করেন, চীনে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে রাজনৈতিক তথ্যের বিকৃত রূপ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তুলনামূলক কম আস্থাশীল অথবা জনগণের আস্থা যিনি কম অর্জন করতে পারেন, এমন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী সহজ উপায়ে ভোটের ফলাফল নিজের পক্ষে আনার জন্য নির্বাচনের আগে কিংবা নির্বাচন চলাকালীন গুজব কিংবা কু তথ্যের আশ্রয় গ্রহণ করেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজব সৃষ্টিকারী পক্ষের চাওয়া থাকে সহিংসতা সৃষ্টি করে মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করা এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। বেতার-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবরকে প্রচার করে এর বিস্তৃতি আরও ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে।

সরকার বিরোধীরা বলছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে সরকার বিপদে আছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি নানা ধরনের চাপ রয়েছে। চাপে পড়ে সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নানা গুজবের আশ্রয় নিচ্ছে। আর এর বড় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। এছাড়া মূলধারার মিডিয়াও অনেক ক্ষেত্রে জনগণের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঠিক তথ্য প্রচার করতে পারছে না বলে অস্থির হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তথ্য জানতে চাইছে সাধারণ মানুষ। এর ফলে মিডিয়া তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ছে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সরকারের নানামুখী চাপের মধ্যে অন্যতম চাপ হলো সরকার জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। তারা শুধু অন্য দলের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে এমন নয়, তারা তাদের নিজেদের দলের মানুষের ভোটাধিকারও কেড়ে নিয়েছে। তারা নানাভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়। তারা চায় জনগণ যদি তাদের পক্ষে না আসে তবুও যেন একটা সংশয়ের মধ্যে থাকে।’

জোনায়েদ সাকি অভিযোগ করে বলেন, ‘এসব মিথ্যা, কু তথ্য ছড়ানোর জন্য তারা সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানকেও ব্যবহার করছে।’

গুজব ছড়িয়ে একটি দেশের নির্বাচনের ফলাফল বদলে দেওয়া যায় কিংবা সুযোগসন্ধানীদের স্বার্থসিদ্ধি হয়, এমন তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে গুজব সৃষ্টিতে উৎসাহী পক্ষের দাপট দিন দিন বেড়ে চলছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে ইভিএম ব্যবহার করার কারণে এই উদ্বেগ আরও বেড়ে চলছে। নির্বাচনে হেরে যাওয়া গোষ্ঠী কিংবা সম্ভাব্য হেরে যাওয়া প্রার্থী রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা ধরনের তথ্য ছড়িয়ে দেন। আর এসব ঘটনা তখনই বেশি ঘটছে, যখন দেশের জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় সচেতন হতে দেওয়া হচ্ছে না কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে জনগণের মতামতকে পরিচালিত করতে চায় এবং স্বার্থ সন্ধানী ব্যবসায়ী-পেশাজীবী-আমলাদের সুযোগ নেওয়ার ধান্দা থাকে। এসব ক্ষেত্রে গুজব কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘আমরা খেয়াল করেছি নির্বাচন এগিয়ে আসলেই দেশের একটি পক্ষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। যাদের দেশের স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা নেই, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নেই তারাই এ কাজটি করে।’

গুজবের ব্যবহার নিয়ে দীপু মনি অভিযোগ তোলেন বিএনপির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, বিএনপি সব সময় গুজব নিয়ে রাজনীতি করে। সাধারণ মানুষের মতামতের ওপরে ভরসা না থাকায় তারা গুজবের ওপরে নির্ভর করে ক্ষমতায় যেতে চায়।

এদিকে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কোনোভাবেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন। এর ফলে বিপরীতমুখী অবস্থান অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে পড়ছে। ফলে দিন দিন রাজনৈতিক অঙ্গন সংঘাতময় হয়ে উঠছে, বাড়ছে শঙ্কা।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আমরা এই দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। আমরা একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাই। যে সংকট এখন বর্তমান প্রেক্ষাপটে আছে, সেটি যখন দলীয় সরকারের বাইরে অর্থাৎ নির্দলীয় সরকার গঠন করা হবে তখন আজ যে সংকটগুলো রয়েছে তার ৯০ শতাংশ কেটে যাবে। তখন আর এসব অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করার কিছু থাকবে না। বাকি ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে খারাপ লোক দেশছাড়া হবে। আর দেশে থাকলে ঘরে ওঠে যাবে। তখন এত ভাবনা চিন্তা করার অবকাশ থাকবে না। 

বাংলাশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের গুজব বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নানা স্বার্থ থাকে। কারও অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে, কারও সামাজিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থ থাকে। নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্র সম্পর্কে ভুল খবর দিয়ে, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা ভোটারদের সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। এর বাইরে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুল ব্যবহার গুজবের অন্যতম মাধ্যম হয়ে পড়ছে। নানা ফেক কনটেন্টে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরপুর। গুজব ও কু-তথ্য ছড়িয়ে নির্বাচনে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করলে এবং সেটার অভিযোগ পেলে নির্বাচন কমিশনের উচিত তাতে গুরুত্ব দেওয়া।

এসপি