ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) আর্থিক সহায়তায় তৈরি হয়েছে মেট্টোরেল। যার প্রথম অংশ উত্তরা (দিয়াবাড়ী) থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর (বুধবার)।

মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন-৬ এর একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর যেতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রোডে একটি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। 

ঢাবি ক্যাম্পাসে মেট্রোরেলের স্টেশন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে শিক্ষার্থীদের। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেও পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। 

আরও পড়ুন : আশা জাগাচ্ছে মেট্রোরেল, কমাবে যানজটের ভোগান্তি

শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে মেট্রোরেল চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে তা উল্টো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যানজট ও শব্দ দূষণ বাড়াবে এবং সর্বোপরি শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করবে। একই সুরে প্রথম থেকেই কথা বলেছে বাম সংগঠনসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন। 'মেট্রোরেলের রুট বদলাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাও' স্লোগানে ক্যাম্পাসে আন্দোলনও করেছিল এই পক্ষ।

আবার শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ যাতায়াতের ভোগান্তি নিরসনের জন্য ঢাবি ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যাওয়াকে সঙ্গত বলেই মনে করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন সংক্রান্ত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ কমিটিই মেট্রোরেলের রুটের পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। একই সুর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে। তারা বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।

শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মনে করি ক্যাম্পাসের মধ্যে মেট্রোরেলের রুট বসিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসের পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাকে আপস করা হয়েছে। মেট্রোরেলের শব্দ যেমন পড়াশোনার পরিবেশে বিঘ্ন ঘটাবে, তেমনি এর স্টেশন অধিক লোকজনের সমাগম ঘটাবে। এতে করে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত মানুষের আগমন ঘটাবে, যা সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিনষ্ট করবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ফুয়াদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়নের অংশ হিসেবে মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু টিএসসিতে স্টেশন স্থাপন করাটা আমার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়। যেটা ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। টিএসসিতে স্টেশন দেওয়ায় যাত্রীদের চাপ বাড়ানোটা ছুটির দিনে বড় জনসমাগমের সৃষ্টি করবে। যা আদতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করবে। যেহেতু শাহবাগেই একটা স্টেশন আছে, সেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর প্রয়োজন ছিল না।

ভিন্নমত পোষণ করেছেন দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রনি ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা যতটুকু জানি, এখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম। যাতায়াতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যে বাস সার্ভিস রয়েছে তার ওপরও চাপ কমাবে মেট্রোরেল। টিউশনিসহ অনেকক্ষেত্রে সুবিধা হবে আমাদের। তবে অসামাজিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাসের ব্যবস্থা থাকতে পারে মেট্রোরেলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, অনেক শিক্ষার্থী উত্তরা, মিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস না পাওয়ায় অনেক সময় তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এজন্য অনেকে নির্ধারিত সময়ে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্টেশন থাকায় তাদের সুবিধা হবে। এছাড়া সাধারণ যাত্রীরা দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এক পলক দেখতে পারবে।

ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের সভাপতি আদনান আজিজ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট ও স্টেশন নির্মাণ হওয়ায় শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পণ্য বানিয়ে ফেলতে এবং কোনো পলিটিক্যাল মুভমেন্ট যাতে গর্জে উঠতে না পারে সেজন্য ক্যাম্পাসে এমন স্থাপনা করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন মেট্রোরেল তৈরির ঘোষণা হয় সে সময় আমরা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো এর বিরোধিতা করি। কারণ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নয় বইমেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বহু ক্ষতির কারণ ছিল এটি। তখন প্রশাসন ও ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে এর পক্ষে অবস্থান নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল স্থাপন একটা খুব বাজে ও ভুল সিদ্ধান্ত। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হবে এবং নানামুখী সংকট বাড়িয়ে তুলবে।  

আরও পড়ুন : মেট্রোরেলে গতি পাবে ঢাকা, ত্বরাণ্বিত হবে সমৃদ্ধি

ঢাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আখতার হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এমনিতেই জনাকীর্ণ, মেট্রোরেল স্টেশন এটিকে আরো জনাকীর্ণ করবে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে শিক্ষার্থীরা এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রদর্শনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এখানে রুট এবং স্টেশন স্থাপনে মত দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেল হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের ড্রিম প্রজেক্ট। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর জন্যঅপেক্ষা করছি। আমি মনে করি, সুন্দর ও কম সময়ে যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে শিক্ষার্থীরা। মেট্রোরেলে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান যে বিশ্বে আমরা বসবাস করি এখানে গতি প্রযুক্তি এবং সেবা, এই জিনিসগুলো আমাদের মনে রেখেই পৃথিবীর সব শহরে কাজ হয়। এটিকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে, পাশাপাশি এই ব্যবস্থাকে যদি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যায় তাহলে এটি কোনো সমস্যা হবে না। আমরা মনে করি, নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে যে বিষয়গুলো আরো উত্তরণ ঘটানোর প্রয়োজন পড়বে সেগুলো কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব সহকারে দেখবে। ব্যবহারকারী এবং সেবাদানকারীর মধ্যে যখন ইতিবাচক যোগসূত্র তৈরি হবে তখন সে জিনিসটা ভালো হয়। শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক ভূইয়াঁ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হবে না। আর স্টেশনে ওঠা-নামার ব্যবস্থা দুটোই একপাশে হয়ে গেছে। উদ্যানের পাশে যদি আরেকটা রাস্তা করে দেওয়া হয় তাহলে টিএসসির রাস্তার বেশি ক্ষতি হবে না। পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়েও মেট্রোরেল গিয়েছে, তবে তারা দূরত্ব রেখেছে। এক্ষেত্রে ভালো নিরাপত্তা দেওয়ার বিকল্প নেই।

এইচআর/জেডএস