চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেটে একজন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধিও নেই। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহজেই নানা অনিয়ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন করে গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে এসব দুর্নীতি। অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমায়ও জড়িয়ে পড়ছে প্রশাসন। নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে একের পর এক হাইকোর্ট থেকে আসছে নিষেধাজ্ঞা ও রুল। তাতেও যেন একটু ভ্রুক্ষেপ নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে উপাচার্যকে একের পর এক চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করে আসছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তাতেও টনক না নড়ায় এবার মাঠে নামছে সংগঠনটি। আন্দোলনের ঘোষণার কথা জানিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর উপাচার্য বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন তারা। এই চিঠি এসেছে ঢাকা পোস্টের হাতে। চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের মূলনীতিকে উপেক্ষা করছে বলে অভিযোগ তুলেছে শিক্ষক সমিতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, শিক্ষক সমিতির ডাকা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমর্থন আছে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুরু থেকেই আইন ও প্রচলিত নিয়ম ভেঙে চলছে। তাদের বারবার চিঠি দিয়েছে শিক্ষক সমিতি। ফারসিসহ বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগে টাকা লেনদেনের বিষয় প্রথম দিকে শোনা গেলেও পরে উপাচার্য দপ্তরের লোকজনই এক প্রকার হাতেনাতে ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি উপাচার্যের পিএসকে দায়ী করেছে।

ফাঁস হওয়া একাধিক ফোনালাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের নাম উঠে এলেও তাদের তদন্তের আওতায়ই আনা হয়নি। এমনকি তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি, যা তদন্তের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তদন্ত কমিটি এই চক্রকে শনাক্ত করতে ফৌজদারি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলার সুপারিশ করলেও উপাচার্য তা আমলে নেননি। এই শিক্ষকদের প্রশ্ন, উপাচার্য নিজে যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকেন তাহলে কেন তিনি মামলা করছেন না।

এদিকে উপাচার্য বরাবর দেওয়া শিক্ষক সমিতির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) ছাড়া সর্বমোট ১৪ পদের মধ্যে চবি সিন্ডিকেটে শিক্ষক কর্তৃক নির্বাচিত বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছয় জন প্রতিনিধিসহ আটটি পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অপর দুটি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেটে দীর্ঘদিন ধরে একটি চরম ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত স্বায়ত্তশাসন তথা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ এর মূলনীতি পরিপন্থি।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, শিক্ষক প্রতিনিধির পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পদোন্নতি বোর্ডসহ অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষা, গবেষণা এবং শিক্ষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ হচ্ছে না। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলোতে যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শিক্ষক সমিতি এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড ও পদোন্নতির বোর্ড সদস্য মনোনয়নের এজেন্ডা অন্তর্ভুক্ত করে কোনো সিন্ডিকেট সভা আহ্বান না করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, দীর্ঘদিন আগে পদোন্নতির জন্য আবেদন করা বেশকিছু শিক্ষকের নির্বাচনী বোর্ড সভা আহ্বান করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু পরবর্তীতে আবেদন করা শিক্ষকদের নির্বাচনী বোর্ড সভা আহ্বান করা হয়। শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদ ২০২২ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রশাসনের কাছে অব্যাহতভাবে ওই নির্বাচনী বোর্ড সভা অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়। বিগত ১৪ অক্টোবর জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করেই সিন্ডিকেট সভায় অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এতে পদোন্নতি না হওয়া শিক্ষকদের নানা ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এর প্রতিবাদে গত ২৪ নভেম্বর সমিতির জরুরি সভায় ২ ডিসেম্বর মধ্যে চবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে শিক্ষক সমিতি কঠোর আন্দোলন করতে বাধ্য হবে বলে উপাচার্যকে লিখিতভাবে জানানো হয়।

শিক্ষক সমিতি চিঠিতে আরও উল্লেখ করে, দীর্ঘদিন আগে আবেদন করা অনেক শিক্ষকের পদোন্নতি বোর্ড ছাড়াই আগামী ৩১ ডিসেম্বর আবারও সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পদোন্নতি বোর্ড আহ্বান ছাড়া যদি এই সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয় তাহলে শীতকালীন ছুটি শেষে শিক্ষক সমিতি কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। চিঠির শেষ দিকে প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনে এই সিন্ডিকেট স্থগিতের দাবিও জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি।

জানতে চাইলে চবি শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রফেসর আবদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটে শিক্ষকদের নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি নেই। ভারসাম্যহীন এই সিন্ডিকেটে নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আমরা শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন ছাড়া সিন্ডিকেট সভা না করার জন্য উপাচার্যকে জানিয়েছি। যদি দাবি মানা না হয় তবে কার্যকরী কমিটি অথবা সাধারণ সভা করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চবির উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

/এসএসএইচ/