কালাজ্বর শনাক্তে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের দাবি ঢাবি গবেষকদের
কালাজ্বর শনাক্তকরণে দ্রুত ও কার্যকরী একটি নতুন মলিকিউলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একদল গবেষক।
সোমবার (২ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাবির প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এসময় গবেষক দলের প্রধান ঢাবির অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মনজুরুল করিম এ তথ্য জানান।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ‘ইতোপূর্বে এ রোগ নির্ণয়ে রক্তের ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক পরীক্ষা এবং অস্থি- মজ্জা, যকৃত, প্লীহা, লিম্ফ নোডের টিস্যু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হতো। যার প্রথমটির রোগ নির্ণয়ে নির্দিষ্টতা কম, আর অন্যটিতে টিস্যু সংগ্রহের সময় মারাত্মক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বিদ্যমান।’
তিনি আরও বলেন, বিগত দশকে বেশ কিছু পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) ভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় প্রক্রিয়া প্রচলিত হয়েছে। যদিও এই প্রক্রিয়া পূর্বে ব্যবহৃত পদ্ধতি হতে রোগ নির্ণয়ে অধিক কার্যকারী। এসব প্রক্রিয়ায় রক্ত, অস্থি-মজ্জা, যকৃত, প্লীহা, লিম্ফ নোডের টিস্যুর নমুনা ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় লেশম্যানিয়ার দেহের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে, তাই আমরা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে রিয়েল টাইম পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যে কালাজ্বর শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি।
বিজ্ঞাপন
‘কালাজ্বরে আক্রান্তদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে তাতে পরজীবীর অস্তিত্ব রিয়েল টাইম পিসিআরের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছিল। রোগীদের একই সেট থেকে রক্তের নমুনা তুলনা করে পরীক্ষার ফলাফলগুলো যাচাই করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে এই রিয়েল টাইম পিসিআরভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পরিক্ষীণটি আগের এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কালাজ্বর রোগীদের থেকে সংগৃহীত অস্থি-মজ্জার নমুনার ওপর প্রয়োগ করা হয়। রিয়েল টাইম পিসিআরভিত্তিক পরীক্ষণটি প্রস্রাবে রক্ত এবং পূর্ববর্তী অস্থি মজ্জার নমুনাগুলো থেকে পরজীবী শনাক্ত করার ক্ষেত্রে শতভাগ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপগুলোতে অর্থাৎ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী সুস্থ ব্যক্তি কালাজ্বরের ন্যায় অন্যান্য রোগ যেমন, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং যক্ষমা আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রস্রাব এবং রক্তের নমুনায় কোনরূপ সংবেদনশীলতা পরিলক্ষিত হয়নি।’
রিয়েল টাইম পিসিআরভিত্তিক এই মলিকুলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং নিখুঁত ভাবে কালাজ্বর শনাক্তকরণের জন্য একটি রোগীবান্ধব পদ্ধতি বলে দাবি করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ মনজুরুল করিম। তিনি বলেন, ‘এ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে কালাজ্বর শনাক্ত করা সম্ভব যা রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশকে কালাজ্বর নির্মূলের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০৩০ সালের মধ্যে উপেক্ষিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ নির্মূলের জন্য নির্ধারিত কার্যপ্রণালীর অন্যতম লক্ষ্য। প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে যে উল্লেখযোগ্য সংবেদনশীলতা এবং নির্দিষ্টতা পাওয়া গিয়েছে তা রক্ত বা আরও জটিল নমুনা যেমন অস্থি-মজ্জা বা প্লীহা এর নমুনাভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে।’
‘অধিকন্তু, প্রচলিত পিসিআর ও নেস্টেড পিসিআরভিত্তিক কৌশলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে, রিয়েল টাইম-পিসিআর-এর একটি ধাপেই রোগকে অধিক নির্ভুলতা ও নিশ্চয়তার সঙ্গে শনাক্তকরণে সক্ষম, যা প্যাথলজিস্টদের জন্য কাজের চাপ কমিয়ে দেবে। এই পদ্ধতিটি একই সঙ্গে চিকিৎসা প্রতি রোগী ও জীবাণুর প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পরজীবীর গতিবিধি, পরিবেশে সংক্রমণের গতিবিধি নিরূপণ এবং মহামারী সংক্রান্ত জরিপ পর্যবেক্ষণেও ব্যবহার করা যেতে পারে।’
ঢাবির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে করা কালাজ্বরের ক্লিনিকাল নমুনা হিসাবে প্রস্রাব ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রথম। এর ফলাফল বিশ্বখ্যাত জার্নাল প্লস গ্লোবাল পাবলিক হেলথে প্রকাশিত হয়েছে। দেশ ও দেশের বাইরে কালাজ্বর নির্মূলে এই গবেষণা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ মনজুরুল করিম।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি উপেক্ষিত রোগ কালাজ্বর। যা লেশমানিয়াসিসের তিনটি রূপের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতী। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে কালাজ্বরের প্রকোপ আছে। যদিও এটি লেশমানিয়া গোত্রের একাধিক পরজীবীর মাধ্যমে ঘটে থাকে, বাংলাদেশে একমাত্র লেশমানিয়া ডেনোভাম পরজীবীর অস্তিত্বই পাওয়া গেছে। কালাজ্বরের সংক্রমণ এতটাই গুরুতর ও মারাত্মক হয়ে থাকে যে, এ রোগে মৃত্যুহার শতকরা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে যদি চিকিৎসা করানো না হয়।
এইচআর/কেএ