জিসান আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তবে শুধু এই পরিচয় নয় বর্তমানে আরেক পরিচয়ে দারুণ পরিচিত হয়ে উঠেছেন জিসান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন বিশ্বসেরা কিছু সিনেমার গল্প পুনর্নির্মাণ করে। তার বানানো জোকার কিংবা থ্রি ইডিয়টস সিনেমার কিছু দৃশ্যের রিমেক বা পুনর্নির্মাণ দর্শকদের জিসান সম্পর্কে জানতে উৎসুক করে তুলেছে।

অনার্স পড়ুয়া জিসান ইতোমধ্যে ‘জিসু এন্টারটেইনমেন্ট’ নামে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যেখানে তার সহযোগিতা করেন বন্ধু, ছোট ভাই এবং সিনিয়ররা। জিসান জিসু এন্টারটেইনমেন্ট নামের প্রযোজনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। সব কনটেন্টের পরিচালনা থেকে শুরু করে প্রধান চরিত্রে তিনি থাকেন।

জিসানের সম্প্রতি করা থ্রি ইডিয়টস ব্যাপক সাড়া ফেললেও এর আগে তিনি আরও চারটি সিনেমা নিয়ে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- হলিউডের জোকার, তামিল ভাষার ৯৬, চঞ্চল চৌধুরীর বিখ্যাত মনপুরা। এছাড়া জিসান আরও কিছু পথ নাটকে কাজ করেছেন।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় জিসানের। নানা গল্পে কথায় তুলে ধরেন জিসান তার নিজের গল্প। 

এখন পর্যন্ত কী কী বিষয়ে কাজ করেছেন? দর্শক কীভাবে নিয়েছে?

এখন পর্যন্ত আমি আটটি কাজ করেছি এর মধ্যে পাঁচটি সিনেমার রিমেইক। সিনেমাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের আয়নাবাজি, মনপুরা আর হলিউডের জোকার, বলিউডের থ্রি ইডিয়েটস এবং তামিল সিনেমা ৯৬ এর রিমেক করেছি। ভিন্ন ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা নিয়ে কাজ করেছি। এর একটা লক্ষ্য ছিল সেটা হলো এক্সপেরিমেন্ট করা। আমি কিংবা আমরা কাজটি করতে পারব কিনা। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন কাজ করেছি। অনেকে বলেন বাংলাদেশে যেসব সিনেমা নিয়ে কাজ করা হয় সেগুলো ভালো হয় না। এজন্য আসলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভিনদেশী অস্কার পাওয়া সিনেমা জোকার নিয়ে কাজ করার দুঃসাহস করেছি। পুরো সিনেমা আমরা করতে পারব না। আমাদের আসলে সে বাজেট নেই।’

ক্যামেরার পেছনে জিসান

সম্প্রতি থ্রি ইডিয়েট সিনেমার রিমেক করা হলো এটা করার গল্পটা যদি বলতেন, এটা করার ক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে কিনা?

থ্রি ইডিয়েট নিয়ে কাজ করা শুরু থেকে বাস্তবায়ন করা এবং দর্শকদের সামনে তুলে ধরা এটা একটা দীর্ঘ সংগ্রামের ফল। প্রায় চারমাস সময় লেগেছে পরিকল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ দিতে। থ্রি ইডিয়েটে ৫৫-৬০ জন মানুষ সরাসরি ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেছে। এতগুলো মানুষকে নিয়ে যখন আমি কাজ করার কথা চিন্তা করলাম তখন আসলে একটু চিন্তায় পড়ে গেছিলাম যে কীভাবে বাস্তবায়ন করব। 

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমি যখন রাতে একা হাঁটতে বের হই তখন ভাবি কোন চরিত্রের সঙ্গে আমার আশেপাশের আমার দেখা কোন মানুষের সবচেয়ে বেশি মিল। সেক্ষেত্রে আমার যাকে সবচেয়ে বেশি সিমিলার মনে হয় আমি তাকে কাস্টিং করি।

থ্রি ইডিয়েটসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল র‍্যাগিং সিন করাটা। প্রায় চল্লিশ জন মানুষ শর্ট প্যান্ট পরে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছে। এই কাজটা খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ এ ধরনের কাজ ক্যামেরার সামনে তো সবাই করতে চায় না।

থ্রি ইডিয়েটের আগে জোকার সিনেমার রিমেক করেছিলেন, জোকার সিনেমাটি রিমেক করার ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন

হলিউডের জোকার সিনেমাটি যখন রিমেক করার চিন্তা করি আসলে এটা একটা দুঃসাহস ছিলো। কারণ এত বড় একটি সিনেমা অস্কারজয়ী চরিত্র। এটা করার জন্য যখন মন স্থির করলাম তখন বড় চিন্তায় পড়ে গেছিলাম পোশাক নিয়ে। এ ধরনের পোশাক যেহেতু বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। তো এক পর্যায়ে আমি জোকারের একটি ড্রেস খোঁজা শুরু করলাম পুরো ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও জোকারের পোশাক পায়নি। তারপর একইরকম গেটাপের একটা ড্রেস আমি ফুটপাত থেকে কিনি এরপর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বন্ধুদের দিয়ে একই রকম রং করিয়ে তারপর সেটা জোকারের জন্য ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে যখন ভিনদেশী সিনেমা নিয়ে কাজ করি তখন পোশাক নিয়ে সমস্যায় পড়ি তবে ম্যানেজ করতে পারি। চাইলে আসলে সবই সম্ভব।

আপনার সাম্প্রতিক কাজের পর দর্শকরা আপনার কাছে কী ধরনের কাজ চায়?

কাজগুলো করার পর দর্শকদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। নব্বই শতাংশ দর্শকের পজিটিভ প্রতিক্রিয়া ছিলো এর মধ্যে কিছু দর্শকের নেগেটিভ মন্তব্য ছিল। তারা যে মন্তব্যগুলো করেছেন সেগুলো দেখেছি। তবে তাদের মন্তব্যগুলো মূলত ছিল যে আমার কাজে কেনো মৌলিকত্ব নেই। তাদের উদ্দেশ্য বলবো যে, আমরা আসলে সিনেমার রিমেইক নিয়ে কাজ করছি। আর এটা করা বেশ চ্যালেঞ্জের। যে সিনেমাটি নির্মাণ বাজেট থাকে ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা আমরা সেই সিনেমাটি রিমেক করছি একদম জিরো বাজেটে। এ ধরনের বড় বড় সিনেমার রিমেক করার ক্ষেত্রে আমরা যখন জিরো বাজেটে কাজ করি এবং সেইম পোশাক সেইম স্থান এবং সেইম শিল্পীকে ক্যামেরার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের। সমালোচনা করাটা সহজ কিন্তু আমরা যারা কাজ করছি তারা জানি কতটুকু চেষ্টা আমাদের করতে হয়। রিমেক কেন করছি এই প্রশ্নের উত্তর হলো এটা প্রমাণ করা যে আমরা চাইলেও আসলে কাজ করতে পারি। আমাদের মেধা আছে, চেষ্টা আছে, আমরা চাইলে পারব।

দর্শকদের চাওয়া জিসান মৌলিক কাজ উপহার দিক, কবে নাগাদ দর্শকদের মনের চাওয়া পূরণ করবেন?

আমার কিছু মৌলিক কাজ সামনে আসছে। খুব শীঘ্রই আমরা নোয়াখালীতে যাব একটি শর্ট ফিল্মের শুটিং এর জন্য। তবে আমি দর্শকদের বলব আমি সময় নিয়েই কাজগুলো করতে চাই। যেহেতু আপনারা আমার মৌলিক কাজ দেখেননি সেহেতু আমি একটু সময় নিয়ে যত্ন দিয়ে কাজগুলো করতে চাই। দর্শকরা আমার কাছে গল্প নির্ভর, চরিত্র নির্ভর কাজ চায় আমি চেষ্টা করব তেমন কিছু উপহার দিতে।

বর্তমানে কী নিয়ে কাজ করছেন?

আমি বর্তমানে ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে একটা কাজ হাতে নিয়েছি। চঞ্চল চৌধুরীর নাটক লাল খাম বনাম নীল খামের রিমেইক নিয়ে আমি এবং আমার পুরো টিম কাজ করছি। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি কাজটি সবার সামনে আনতে পারব বলে আশা করছি।

অভিনয়ে কেন আসা?

অভিনয়ে কাকতালীয়ভাবে আসা। ২০১৬ সালে আমার অভিনয় জার্নি শুরু হয়, তখন আমি সবে কলেজে পড়ি। অভিনয়ে এসেছিলাম মূলত মনে জমা কষ্ট, জিদ, ক্ষোভ থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে অভিনয়টা ভালো লেগে যায়। একবার আমার বন্ধুরা তাদের সঙ্গে আমাকে ছবি তুলতে নেয়নি আমার গায়ের রংয়ের কারণে। যার কারণে আসলে মনে খুব খারাপ লেগেছিল। তখন মনে হয়েছিল এমনকিছু করব যাতে ওরা একদিন আমার সাথেই ছবি তুলতে আসে। এরকমটা মনে মনে ভেবেছিলাম। তারপর আসলে ভাবলাম অভিনয়টা শুরু করি। তাইলে হয়তো সেটা সম্ভব হবে। এই জিদ থেকে যে অভিনয়টা শুরু করলাম এরপর থেকে এই সাত বছর ধরে অভিনয়ের সঙ্গে আছি। এখন তো নিজেকে অভিনয়ের বাইরে কল্পনা করতেই পারি না।

অভিনয়ে আপনার অনুপ্রেরণা কে?

অভিনয়ে তো এসেছিলাম জিদ থেকে। এরপর জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হলাম অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন শিখছি। এখানে আসার পর থেকে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা পেয়েছি হুমায়ুন ফরিদী এবং চঞ্চল চৌধুরীর কাছে। হুমায়ুন ফরিদীর কাছে পেয়েছি কারণ তিনি আমার ক্যাম্পাসের বড় ভাই। জাহাঙ্গীরনগরের অনেকে আমাকে বলেন তুমি পরবর্তী হুমায়ুন ফরিদী হবে। অনেকে তার জায়গায় রেখে আমাকে কল্পনা করেন এটা আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। এত বড় একজন গুণী মানুষের উত্তরসূরী যখন কেউ আমাকে বলে তখন আমার খুব ভালো লাগে। আর দ্বিতীয়ত হলো চঞ্চল চৌধুরী। আমি যখন আয়নাবাজী এবং মনপুরা সিনেমার রিমেক করি তখন তিনি আমার কাজগুলো দেখেছেন উৎসাহ দিয়েছেন। গতমাসে আমি উনার দাওয়াতে উনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। এখন তো উনার পরিবারের সাথে আমার খুব ভালো একটি সম্পর্ক হয়ে গেছে। চঞ্চল চৌধুরী আমার সকল কাজে খুব উৎসাহ দেন। আমি উনাদের দুজনকে আমার অনুপ্রেরণা মনে করি।

দর্শকদের উদ্দেশ্য কী বলতে চান?

দর্শকদের উদ্দেশ্য বলতে চাই আমি ভালো কাজ করতে চাই, একজন ভালো অভিনেতা হতে চাই। যারা আমাকে ভালোভাবে নেন তাদেরকে বলব আপনারা আমাকে একটু ভালোবাসা দেন। আমি ইনশাআল্লাহ আপনাদেরকে ভালো কাজ উপহার দেব, ভালো কাজ উপহার দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব। আপনারা সঙ্গে থাকলে, আপনাদের সাপোর্ট ও ভালোবাসার ওপর ভর করে আমি অনেকটা দূর যাব আশা করি।

 মো. আলকামা/আরকে