১৪৯ বছরের পথচলায় কবি নজরুল সরকারি কলেজ
১৮৭৪ সালের ১৬ মার্চ গোড়াপত্তন হয়েছিল দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম বিদ্যাপীঠ কবি নজরুল সরকারি কলেজের। কালের পরিক্রমায় ১৪৯ বছরের পথচলায় লাখ লাখ বিদ্যার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান চত্বর। এখানে পড়াশোনা করেই জন্ম হয়েছে অনেক খ্যাতনামা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতা, কবি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদের। এই কলেজটির সৃষ্টির পেছনে রয়েছে লম্বা এক ইতিহাস। বিট্রিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাদ্রাসা হিসেবে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্বেলের আমলে তখনকার মাদ্রাসা সংস্কার কমিটির অনুমোদনে মহসিন ফান্ডের টাকায় যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৮৭৪ সালের ১৬ মার্চ কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মডেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তিনটি নতুন মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। যদিও হাজী মোহাম্মদ মহসিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত এসব মাদ্রাসাগুলোর নাম দেওয়া হয় মহসিনিয়া মাদ্রাসা। তবে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা বহুল পরিচিতি লাভ করে ‘ঢাকা মাদ্রাসা’ নামে। বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে এগুলো ছিল মুসলমানদের জন্য করা প্রথম সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বিজ্ঞাপন
এর আগে ১৮৭৩ সালের জুলাই মাসে এক সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা মাদ্রাসার জন্য মহসিন ফান্ড থেকে বছরে দশ হাজার টাকার অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়। দীর্ঘ ৪২ বছর মহসিন ফান্ড থেকেই ঢাকা মাদ্রাসার সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এরপর ১৯১৫ সালের ১৬ নভেম্বর এক সরকারি আদেশে মাদ্রাসার ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব বাংলা সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
বিজ্ঞাপন
এর আগে ১৮৮০ সালে প্রথম অধ্যক্ষ মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দীর তত্ত্বাবধানে মুসলিম স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী মাদ্রাসা ভবন তৈরি করা হয়। এ ভবনের নকশা করেছিলেন মেজর ম্যান। প্রকৌশলী ভিভিয়ান ও স্কট সেই নকশা অনুযায়ী নতুন ভবন তৈরি করেন। তাদের এ কাজে সহায়তা করেছিলেন প্রকৌশলী রাখাল চন্দ্র দাস। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা লগ্নেই তিনি ইংরেজি ক্লাস খোলার ব্যবস্থা করেন ও সেই ইংরেজি বিভাগের (পরবর্তী এ্যাংলো-পারসিয়ান বিভাগ) প্রথম হেডমাস্টার ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র মোহন দত্ত।
প্রতিষ্ঠানটিতে এখনও বাবু রাজেন্দ্র মোহন দত্তের স্মৃতি রয়েছে। কলেজের প্রধান ভবনের উত্তরদিকের কাঠের সিঁড়ির ওপর শ্বেতপাথরের ফলকে তার নাম লিখে রাখা হয়েছে।
জানা যায়, শুরুতে মাদ্রাসায় সাতটি শ্রেণি ছিল। আরবি বিভাগে শুধু আরবি শিক্ষার্থীরা পড়ত। ইংরেজি বিভাগে (পরবর্তীতে এ্যাংলো পারসিয়ান বিভাগ) ইংরেজি শিক্ষার্থীরা পড়ত। এ বিভাগে এন্ট্রাস (ব্রিটিশ ভারতে প্রচলিত প্রবেশিকা পরীক্ষা বিশেষ) পর্যন্ত পড়ানো হতো। এখান থেকে ছাত্ররা ১৮৮১ সালে প্রথম এন্ট্রাস পরীক্ষা দেয়। ইংরেজি বিভাগে আরবি, ফারসির সঙ্গে ইংরেজি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান পড়ানো হতো। কিছুদিনের মধ্যেই এ বিভাগ এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, ১৮৮৩ সালের মধ্যে মাদ্রাসার ৩৩৮ জন ছাত্রের মধ্যে ২০২ জন ছাত্রই ছিল এ্যাংলো পারসিয়ান বিভাগের।
এরপর ১৯১৫ সালে সরকার কর্তৃক অন্যান্য মাদ্রাসার মতো নিউ স্কিম পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মাদ্রাসা থেকে হাই মাদ্রাসা (শিক্ষাক্রমের পর্যায় বাড়ানো হয়) হয়। ১৯১৬ সালে এ্যাংলো পারসিয়ান বিভাগ আলাদা হয়ে ঢাকা গভঃ মুসলিম হাই স্কুল হয়। ১৯১৯ সালে স্পেশাল ইসলামি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা ও ১৯২১ সালে স্পেশাল ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার প্রচলন হয়।
এরপর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র ভর্তির সুবিধার্থে ১৯২৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানকে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে মাদ্রাসা বিভাগে চারটি শ্রেণি ও কলেজ বিভাগে দুটি শ্রেণি ছিল। ১৯৫৭ সালে মানবিক ও ১৯৭০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়।
১৯৫৮ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ১৯৬২ সালে মাদ্রাসা তুলে দিয়ে মাদ্রাসার ক্লাসগুলোকে মাধ্যমিক ক্লাসে পরিণত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ঢাকা মাদ্রাসা পরিচিতি লাভ করে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের স্কুল বিভাগ হিসেবে। এরপর ১৯৬৮ সালে কলেজ থেকে স্কুল আলাদা হয়ে গিয়ে নাম হয় ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল, ঢাকা। কলেজের প্রধান ভবনের নিচতলায় উত্তর-পূর্বাংশের এই স্কুলের কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে।
১৯৬৮ সালে স্কুল আলাদা হয়ে যাওয়ার পর কলেজের নামও পাল্টে রাখা হয় সরকারি ইসলামিয়া কলেজ, ঢাকা। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় নাম পরিবর্তন করে ‘কবি নজরুল সরকারি কলেজ’ রাখা হয়। অদ্যাবধি এ নামেই পরিচিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কলেজে ছেলে ও মেয়ে অর্থাৎ সহশিক্ষার প্রচলন হয় ১৯৭৮ সালে।
বর্তমানে কলেজের গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। কলেজের ১৭টি বিভাগে ১০৯ জন (সংযুক্তিসহ) শিক্ষক কর্মরত আছেন। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৬৯ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে কবি নজরুল সরকারি কলেজে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। কলেজের একটি আবাসিক ছাত্রাবাসও রয়েছে। ফরাশগঞ্জের মোহিনীমোহন দাস লেনে কলেজ ছাত্রাবাসটি অবস্থিত। স্বাধীনতা সংগ্রামে কলেজের ছাত্র শহীদ শামসুল আলমের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস’।
বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৯ সালে কলেজটিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা চালু হয়। ১৯৮৫ সালে কলেজে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে প্রথম স্নাতক (সম্মান) কোর্স খোলা হয়। ১৯৯৩ সালে কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রথম পর্ব মাস্টার্স কোর্স চালু হয়।
১৯৮২ সালে কলেজটিতে বিএনসিসি কন্টিনজেন্ট ও রোভার স্কাউট ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯৭ সালে হিসাববিজ্ঞানে প্রথম পর্ব মাস্টার্স এবং হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও ইংরেজি বিষয়ে অনার্স কোর্স খোলা হয়। ২০০৪ সালে এই কলেজে বাংলা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও ভূগোলসহ মোট ১২টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়।
২০০৬ সালে বাংলায় প্রথম পর্ব স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়। প্রচলিত শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতটি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। যার মধ্যে কবি নজরুল সরকারি কলেজ একটি। বর্তমানে কলেজে মোট ১৭টি বিষয়ে অনার্স, পাঁচটি বিষয়ে প্রথম পর্ব মাস্টার্স এবং চারটি বিষয়ে শেষ পর্ব মাস্টার্স কোর্স ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে।
দেশের রাজনীতি, সাহিত্য ও শিল্পাঙ্গনসহ বিভিন্ন জায়গায় কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা সুনামের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন। যার মধ্যে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি নুরুল ইসলাম, বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক কায়কোবাদ, প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজল, চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনসহ অসংখ্য গুণী মানুষের শিক্ষাজীবনের সাক্ষী এই কবি নজরুল সরকারি কলেজ। অতীতের ধারাবাহিক গর্ব এবং গৌরব বজায় রেখে আগামী দিনেও শিক্ষার সুষ্ঠু ধারা বজায় রেখে উন্নত বাংলাদেশের পক্ষে নিজের অবস্থান ধরে রাখবে ১৪৯ বছরে পা দেওয়া কবি নজরুল সরকারি কলেজ, এমন প্রত্যাশা করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
(ইতিহাস কলেজের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়া থেকে নিয়ে সম্পাদনা করা হয়েছে)
আরএইচটি/কেএ