পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে তিন শিক্ষার্থীকে রাতভর পাশবিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে এই ঘটনা ঘটে।

নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা হলেন- লোকপ্রশাসন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী গোলাম রহমান জয়, ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আসাদুল ইসলাম এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল আজিজ।

অভিযুক্তরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবু, মাসুদ রানা সরকার (গণিত বিভাগ, ৮ম ব্যাচ), প্রান্ত (সমাজকর্ম বিভাগ, ৮ম ব্যাচ), শামীম (পদার্থবিজ্ঞান, ৮ম ব্যাচ) শেহজাদ (বিবিএ, ১০ম ব্যাচ), হৃদয় (বিবিএ, ১০ম ব্যাচ), রেইন (পদার্থবিজ্ঞান, ১০ম ব্যাচ), আপেল (গণিত বিভাগ, ১০ম ব্যাচ), সোহান (ইংরেজি ৯ম ব্যাচ), সালমান (ইংরেজি ৯ম ব্যাচ), শিবু (লোকপ্রশাসন, ১১তম ব্যাচ), লিখন (ইউআরপি বিভাগ, ১১তম ব্যাচ), আকিব (পদার্থবিজ্ঞান, ১১তম ব্যাচ), অয়ন (বাংলা বিভাগ, ১১তম ব্যাচ), আশরাফুল (গণিত বিভাগ, ১২তম ব্যাচ)-সহ শতাধিক শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মী আপেল, শেহজাদ, তোফিকসহ ১০-১২ জন শিক্ষার্থী এসে ওই তিন শিক্ষার্থী শিবির কি না জানতে চান। পরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শহীদ মিনার থেকে তাদেরকে হলে নিয়ে যান। এরপর ওই তিন শিক্ষার্থীকে হলের তিনটি রুমে নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে স্ট্যাম্প, রড, হকিস্টিক, প্লাস, হাতুড়ি, জিআই পাইপ, তালাসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নির্যাতন করেন। এ সময় ওই শিক্ষার্থীদের প্লাস দিয়ে হাত এবং পায়ের নখ তুলে নেন। পরে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাদের হাত এবং পায়ে সুঁই ফুটানো হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, যদি ওই শিক্ষার্থীরা কোনো অন্যায় করে থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এভাবে বর্বরোচিত নির্যাতন মোটেই কাম্য নয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এখন আতঙ্কিত। শিবির বলে কখন আবার আমাদেরকে নির্যাতন করেন সেটা বুঝতে পারছি না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী জানান, এই ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী। প্রক্টর যখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন তখনো ওই শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন করা হয়। তিনি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য মারধরের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. মো. ওমর ফারুক বলেন, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার কল পেয়ে হলে এসে ওই শিক্ষার্থীদেরকে দেখতে পাই। তারা আমার হলের শিক্ষার্থী নয়, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে। তারা শিবির বলে স্বীকারোক্তি দিলে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

তবে শিক্ষার্থীদেরকে মারধরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবু।  তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মারধরের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত না। প্রভোস্ট স্যারের কল পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাহায্যে তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করি।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক শিক্ষার্থী

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা নাজমুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করতে ১৫ জন শিবিরকর্মী গোপন মিটিং করছিল। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের খবর দিলে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশে দেওয়া হয়। তাদের জিজ্ঞাসবাদ করা হয় যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের কোনো ইউনিট আছে কি না। নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কামাল হোসেন বলেন, রাত সাড়ে ১২টায় হলে ছাত্রশিবিরের মিটিং চলছে এই মর্মে একটি কল আসে। পরবর্তীতে প্রক্টরিয়াল টিম, হল প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টাকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে উদ্ধার করি। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বই উদ্ধার করা হয় এবং পরবর্তীতে তাদেরকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

নির্যাতনের পর হাসপাতালে ভর্তি না করে পুলিশে দিলেন কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওই মুহূর্তে তারা নির্যাতনের কথা আমাদের কাছে জানায়নি।

পাবনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্দু বালা বলেন, গতকাল রাত ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর পুলিশ পাঠাতে বললে আমাদের টিম ওখানে যায়। শিবির সন্দেহে তিনজনকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। রক্তাক্ত অবস্থা দেখে একজনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে আজ বুধবার সকাল ৬টার দিকে শহরের একটি মেস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় শিবির সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউআরপি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ছাব্বির হোসেন শাওন নামে এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। ওই শিক্ষার্থীর বন্ধুরা জানান, পাবনা শহর থেকে ঝিনাইদহ যাওয়ার বাস থেকে ছাত্রলীগের শেহজাদ, আপেল, হৃদয়, পিয়াস দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শাওনকে তুলে নিয়ে যায়।

ইউআরপি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. কামরুল হাসান বলেন, এই বিষয়ে আমি অবগত নয়। এমন ঘটনা ঘটে থাকলে নিয়ম মোতাবেক  বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং ছাত্র উপদেষ্টাদের জানানো হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা নাজমুল ইসলাম বলেন, নিখোঁজ শিক্ষার্থীর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাবনা পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী বলেন, খবর পেয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহত অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া নির্যাতিতরা অভিযোগ দিলে তদন্ত করে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাকিব হাসনাত/এমজেইউ