হামলার ঘটনায় একটি বাস পুড়িয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) ১১ শিক্ষার্থীকে মেস থেকে বের করে অমানুষিক নির্যাতনের দুই বছর পার হলেও সেই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অভিযুক্তরা ক্ষমতাসীন হওয়ায় রাজনৈতিক চাপে এ ঘটনার তদন্ত থেকে পিছু হটেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনাটি এড়িয়ে চলছে বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। ফলে এ ঘটনায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বরিশাল নগরীর রূপাতলী বিআরটিসি বাস কাউন্টারে এক ছাত্রকে ছুরিকাঘাত ও তার সঙ্গে থাকা এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করে বাস শ্রমিকরা। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে সেই রাতেই বাস কাউন্টার ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে ঘটনার দিন গভীর রাতে স্থানীয় রূপাতলী হাউজিংয়ের একটি মেসে থাকা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ শিক্ষার্থীকে মেস থেকে বের করে এনে বেধরক মারধর করে শ্রমিকরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করে এবং একটি বাস পুড়িয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে ১৮ ফেব্রুয়ারি বেশ কয়েকটি দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের আলোচনার টেবিলে ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার পরে এক শ্রমিককে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। ওই সময় মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ন্যাক্কারজনক এমন হামলার বিচার করবেন বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু মাসের পর মাস পার হলেও সেই ঘটনার বিচার পাননি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা।

শ্রমিকদের হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে রাজি না হলেও ওই ঘটনায় আহত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইছে না শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা হয়েছিল তার বিচার হোক। ঘটনার পরে শিক্ষার্থীরা বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে গেলেও এর কোনো সমাধান হয়নি। এমনকি বর্তমানে তিনি ওই বিষয়ে আর কোনো আগ্রহও দেখাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।

আরেক শিক্ষার্থী মুঠোফোনে বলেন, হামলায় শুধু ১১ জন শিক্ষার্থী আহত হননি। আরো কয়েকজন আহত হয়েছিলেন। বিচারের দাবিতে আমাদের আন্দোলনও জোড়ালো ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ক্যাম্পাসের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার গোপন আঁতাতে আন্দোলন ভেস্তে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা বললেও আদতে তা হয়নি, বরং উপাচার্য কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে বৈঠক করে ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনাটি পাশ কাটিয়ে গেছেন। যে ছাত্রলীগ নেতারা বৈঠকে বসেছিল তারা হামলায়ও আহত হয়নি।

রূপাতলী হাউজিংয়ের বাসিন্দা ও ওই ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ওই রাতে শ’খানেক লোক এসে ছাত্রদের মেস থেকে নামিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। আমি নিজ চোখে দেখেছি কাওছার হোসেন শিপনের নেতৃত্বে শ্রমিকলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের মারধর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেস ছেড়ে গেছেন। কিন্তু হামলাকারীদের কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

হামলায় আহত এক ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে এমনকি আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বাস মালিক সমিতির নেতা কাওছার হোসেন শিপন, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা শাহরিয়ার বাবু ও মামুন ওরফে তেল মামুনের নাম জানিয়েছি। এছাড়া ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন ছিলেন যারা পদস্থ নেতা। কিন্তু তাদের নাম দেখে সকল প্রশাসন পিছিয়ে গেছে।

মাহমুদুল হাসান তমাল নামে এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই রাতে আমাকে মারধর করেনি তবে আমি যে বাসায় থাকি সেই বাসায় হামলা করা হয়। হামলার ঘটনা লাইভ করে সকলকে জানিয়েছিলাম। ওই ঘটনার আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। কিন্তু আমার কোনো বক্তব্য শুনতে চায় না প্রশাসন।

তিনি আরও বলেন, কাওছার হোসেন শিপনের নেতৃত্বে ওই রাতে হামলা হলো, অথচ এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সেই শিপনকে আমরা অতিথির আসনে বসতে দেখেছি। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতজানু অবস্থানকে স্পষ্ট করে।

মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি সর্ম্পকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা নির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারেনি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সুপ্রভাত হালদার বলেন, মামলার সর্ম্পকে এখনই আমি কিছু বলতে পারবো না। খোঁজ খবর নিয়ে আগামী সোমবার (১০ এপ্রিল) লিখিতভাবে আমাদের বক্তব্য জানাতে পারবো।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. খুরশিদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি আদালতে উপস্থাপন করবে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিচার নিশ্চিত করতে পিছু হটলে আমরা মামলা করতাম না। মামলা করেছি বিচারের আশায়। তবে তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের। মামলার গতি নির্ভর করছে তাদের ওপর।

এ ব্যাপারে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। তবে কী অবস্থায় রয়েছে তা তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা না বলে জানাতে পারবো না।

এদিকে, এ বিষয়ে জানতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনের মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, হামলায় আহত হয়েছিলেন মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুরুল্লাহ সিদ্দিকী, রসায়ন বিভাগের এস.এম সোহানুর রহমান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আহসানুজ্জামান, গণিত বিভাগের ফজলুল হক রাজীব, সামাজ বিজ্ঞান বিভাগের আলীম সালেহী, বোটানি ও ক্রপ সাইন্সের আলী হাসান, বাংলা বিভাগের মো. রাজন হোসেন এবং মার্কেটিং বিভাগের মাহবুবুর রহমান, মাহাদী হাসান ইমন, মিরাজ হাওলাদার ও সজীব শেখ।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এবিএস