বরিশাল বিশ্ববিদ‌্যালয়ের (ববি) দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন‌্য কোনো শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ নেই। অন্য বিভাগের ক্লাসের বিরতিতে কক্ষ খালি পেলে শিডিউল করে ক্লাস নেয় বিভাগটি। এমন চরম শ্রেণিকক্ষ সংকটের মধ‌্যে ২০২২ সালে নতুন করে সমাজকর্ম বিভাগ খোলা হয়েছে। এই বিভাগটির জন‌্যও শ্রেণিকক্ষ নেই। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির তৃতীয় তলায় ক্লাস ও অফিস কক্ষের ব‌্যবস্থা করা হয়েছে।

শুধু দুটি বিভাগ নয়, ছয়টি অনুষদের ২৫টি বিভাগের ৯ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী এমন ভোগান্তিতে শিক্ষাজীবন পার করছে। ছয়টি ব্যাচের জন্য মাত্র একটি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। তাতে সিডিউল করে দিনে প্রতি ব‌্যাচের একটি করে ক্লাস নেওয়া সম্ভব। যেদিন পরীক্ষা থাকে সেদিন ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়। এক যুগেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বিশ্ববিদ‌্যালয়টির এই সংকট কাটাতে কোনো উপাচার্যই উদ‌্যোগ গ্রহণ করেনি। এমন পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববিদ‌্যালয় প্রশাসন থেকে প্রকল্প শেষ হওয়া না হওয়ার ওপর দায় চাপানো হচ্ছে।

২০১১ সালে অস্থায়ী ক‌্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করা বরিশাল বিশ্ববিদ‌্যালয় ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি কর্ণকাঠি স্থায়ী ক‌্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। ৫০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ক‌্যাম্পাসে বিশ্ববিদ‌্যালয়টিতে আজ পর্যন্ত অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনেই প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন, ট্রেজারার কক্ষ, উপাচার্য কক্ষ, পরিবহন দপ্তর, আইটি দপ্তর, অর্থ দপ্তর, পরিকল্পনা দপ্তর, রেজিস্ট্রার দপ্তরসহ ৬টি অনুষদের ২৫টি বিভাগের সকল কার্যক্রম চলে।

বিশ্ববিদ‌্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হতে সময় লাগে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। সরকারি বিধান মতে প্রথম প্রকল্প সমাপ্তির জরিপ মন্ত্রণালয়ে না পাঠালে দ্বিতীয় প্রকল্পের প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হয় না। সে অনুসারে ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হতে ২০২১ সাল লেগে যাওয়ায় ইতোমধ‌্যে ৫ বছর পিছিয়ে গেছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী রাব্বি খান বলেন, বিভাগে মাত্র একটা ক্লাস রুম থাকার কারণে একসঙ্গে একাধিক ব্যাচের ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। এক ব্যাচের ক্লাস হলে অন্য ব্যাচকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিক্ষকরাও সিলেবাস শেষ করার জন্য যথেষ্ট সময় পান না। সময়মতো পরীক্ষা নিতে পারেন না।

রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের তুলনায় ল্যাব রুমের সংকট রয়েছে ৷ অনেক যন্ত্রপাতিও নেই। ল্যাব রুমের সংকটের কারণে আমাদের গ্রুপে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে আমরা ব্যবহারিক কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।  

মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিলান সরদার বলেন, শ্রেণিকক্ষ সংকট আমাদের একটা মারাত্মক সমস্যা। বেশিরভাগ বিভাগেই একটা করে শ্রেণিকক্ষ। তবে কোনো কোনো বিভাগে দুটি, তাও আবার একসঙ্গে না। প্রায় সময় ৫-৬টা ব্যাচকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । এতোগুলা ব্যাচের শ্রেণিকক্ষ মাত্র একটা, যে কারণে স্যাররা নিয়মিত ক্লাস নিতে পারেন না। মাঝে মাঝে এমনই হয় যে আমাদের ক্লাস হচ্ছে আর অন্য আর একটা ব্যাচ অপেক্ষা করছে। 

ক‌্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, ৬টি অনুষদের আওতায় ২৫টি বিভাগ রয়েছে। এই পঁচিশটি বিভাগের জন্য পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের দুটি ব্লককে একাডেমিক ভবন-১ ও একাডেমিক ভবন-২ নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে ২৫টি বিভাগের জন্য মোট ক্লাসরুম রয়েছে ৩৬টি ও ল্যাব রয়েছে ৩১টি। এদের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আওতাধীন ৫টি বিভাগ যথাক্রমে  অর্থনীতি বিভাগ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের জন্য মাত্র ১টি করে শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং অনুষদের জন্য সম্মিলিত একটি কক্ষ বরাদ্দ রয়েছে। সমাজকর্ম বিভাগ ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করে। একাডেমিক ভবনে শ্রেণিকক্ষ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির তৃতীয় তলায় শ্রেণিকক্ষ  ও অফিস কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কলা ও মানবিক অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ইংরেজি বিভাগ ও ইতিহাস বিভাগের জন্য একটি শ্রেণিকক্ষ, বাংলা বিভাগের জন্য দুটি শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ থাকলেও ২৫০৫ নং কক্ষ বাংলা বিভাগ ও আইন বিভাগকে যৌথভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দর্শন বিভাগের জন্য কোনো শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অন্য বিভাগের রুম খালি থাকা সাপেক্ষে শিডিউল করে ক্লাস নেয় বিভাগটি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের জন্য দুটি শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ থাকলেও মার্কেটিং বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগগুলোর জন্য মাত্র একটি করে শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে প্রশাসনিক ভবনে বিজনেস অনুষদের ৪টি বিভাগের জন্য ১টি শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের গণিত বিভাগের জন্য ২টি শ্রেণিকক্ষ ও ২টি ল্যাব, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জন্য শুধু ৬টি ল্যাব, রসায়ন বিভাগের জন্য ১টি শ্রেণিকক্ষ ও ২টি ল্যাব, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জন্য ২টি শ্রেণিকক্ষ, ২টি ল্যাব, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের জন্য ২টি শ্রেণিকক্ষ ও ২টি ল্যাব এবং পরিসংখ্যান বিভাগের জন্য ১টি শ্রেণিকক্ষ ও ১টি ল্যাব রয়েছে। জীববিজ্ঞান অনুষদের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শ্রেণিকক্ষ ২টি, ল্যাব রুম ৩টি, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২টি শ্রেণিকক্ষ, কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১টি শ্রেণিকক্ষ ও ১টি ল্যাব রুম রয়েছে। 

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম‌্যান সহকারী অধ‌্যাপক ইমরান হোসেন বলেন, শ্রেণিকক্ষ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিটি বিভাগকে এই সংকট বিবেচনা করে সিডিউল করেই ক্লাস নিতে হচ্ছে। এতে পাঠদানে কিছুটা বিড়ম্বনা হয়। তারপরও আমরা শিক্ষকরা চেষ্টা করি সীমাবদ্ধতার মধ‌্যে হলেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রেখে পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার।

গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের একটা নিদিষ্ট রুটিন করা আছে। সব রুটিন এমনভাবে করা যে কোনো একটি কারণে ক্লাস মিস হলে ক্লাসরুম সংকটের কারণে ওই ক্লাস পরবর্তীতে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ক্লাসরুম সংকটের মধ্যেই আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বিশ্ববিদ‌্যালয়ের প্রক্টর ড. খোরশেদ আলম বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ‌্যালয়টি অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ‌্যালয়। যদিও এই বিশ্ববিদ‌্যালয়টি এক যুগ পার করেছে। শিক্ষার্থীরা যে সংকটগুলো বলেছে এটি সত‌্য। অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ সংকটে রয়েছে। সংকট থাকা সত্ত্বেও পাঠদানে অসুবিধা হচ্ছে না। শিক্ষকমন্ডলী আন্তরিক প্রচেষ্টা দিয়ে পাঠদান নিরবচ্ছিন্ন রেখেছেন।

বিশ্ববিদ‌্যালয়ের উপ-প্রধান প্রকৌশলী মুরশিদ আবেদীন জানিয়েছেন, প্রথম প্রজেক্ট শেষ হতে বিলম্ব হওয়ায় নতুন প্রজেক্ট ফাইল এখনো উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এজন‌্য অবকাঠামোগত দিক থেকে আমরা পিছিয়ে রয়েছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ সংকটে ভুগছেন। আমরা চেষ্টা করছি দ্বিতীয় প্রকল্প প্রস্তাবের। দ্বিতীয় প্রকল্প পাস হয়ে এলে এই সংকট ক্রমান্বয়ে কেটে যাবে।

বিশ্ববিদ‌্যালয়ের উপচার্য (রুটিন দায়িত্ব) ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, শ্রেণিকক্ষ সংকট সমাধানে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ‌্যালয় প্রশাসন এসব সংকট কাটাতে কাজ করছে। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর