ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের মসজিদে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের রোজার ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে আয়োজিত আলোচনা সভায় হামলার ঘটনায় বিভাগের সাত শিক্ষার্থী আহত হন। এ হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

ঘটনার পর প্রকাশিত সংবাদে হামলাকারীদের ‘বহিরাগত ছাত্রলীগ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন, হামলাকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।

তাদের দাবি, নিজেকে আড়াল করার জন্য ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম ওরফে সুজনকে হামলায় ব্যবহার করেন। অন্যদিকে অভিযুক্তরা ও ছাত্রলীগের ঢাবি শাখা সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

সৈকত বলেন, ওইদিন একই সময়ে সিনেট ভবনে উপাচার্যের একটা প্রোগ্রাম ছিল, যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন। আমি নেতাকর্মীদের নিয়ে সেখানে ছিলাম। সুতরাং একইসঙ্গে দুটি আলাদা জায়গায় নেতাকর্মীরা থাকতে পারে না। তারা (ভুক্তভোগী) অভিযোগ করতেই পারে। তবে আমি অপরাধ না করেও কেন দায় কাঁধে নেব?

এদিকে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সুজন বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের নিচতলার মসজিদে গিয়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের বাইরে বের হতে বলেন। তার কথা মতো শিক্ষার্থীরা বাইরে বের হয়ে গেটের কাছে পৌঁছালে সেখানে হামলা চালায় ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ভুক্তভোগীরা কয়েকজন হামলাকারীকে চিহ্নিত করেছে। তাদের ভাষ্যমতে হামলায় জড়িতরা হলেন– শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম সুজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের পাঠাগার উপ সম্পাদক খালিদ হাসান নিলয়, একই হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আরাফাত ইসলাম প্লাবন, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আকতারুল করিম রুবেল, বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপ-সম্পাদক শাকিবুল ইসলাম সুজন, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক মুশফিকুর রহমান, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ইব্রাহিম খান ও একই হলের আরেক সহ-সভাপতি রাশেদুজ্জামান রনি, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহ সুলতান অপু, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তাওহিদুল ইসলাম রিসাল, একই শাখার উপ-দপ্তর সম্পাদক নাঈমুর রহমান ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নাহিদ ভূঁইয়া।

ঘটনার পর হামলা নিয়ে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, আইন বিভাগের একদল জামায়াত-শিবিরের ছেলেরা সেখানে ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ শীর্ষক সেমিনার করতে বসেছিল কিন্তু তারা সবাইকে তাবলীগ বলে বেড়াচ্ছে। পরে সেখানে থাকা স্থানীয়রা তাদের সেমিনার করতে নিষেধ করলে তারা স্থানীয়দের সঙ্গে তারা তর্কে জড়ায় এবং একসময় তারা স্থানীয়দের ওপর হাত তোলে। এসময় ধর্মপ্রাণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের এ অপতৎপরতা রুখে দেয়।

তানভীর হাসান সৈকত ‘ধর্মপ্রাণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা’ উল্লেখ করলেও হামলাকারীরা শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও তার অনুসারী। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের ধারণা, সৈকতের নির্দেশেই এ হামলা হয়েছে।

কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সেদিনের ঘটনায় আমরা তানভীর হাসান সৈকতের কয়েকজন অনুসারীকে চিহ্নিত করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ কিছুটা অস্পষ্ট হলেও আমাদের অনেকে মার খাওয়ার সময় তাদের দেখেছিল, যা আমরা তাদের ছবি দেখে শনাক্ত করি। আমাদের ওপর আক্রমণকারীরা আমাদের পরিচিত না হওয়ায় তাৎক্ষণিক আমরা তাদের চিনতে পারিনি। এ ঘটনা সৈকতের নির্দেশেই ঘটানো হয়েছে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রাফিদ হাসান সাফওয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ও আমার সহপাঠীরা ঘটনার সময় কয়েকজনকে দেখতে পাই, যারা আমাদের ওপর হামলা করেছে। তখন আমরা তাদের কাউকে চিনতাম না। তবে পরে সিসিটিভি ফুটেজ ও ফেসবুকে তাদের ছবি দেখে তাদের শনাক্ত করি।

পরে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, যারা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে তাদের নাম লুকানো হবে আমাদের জন্য বড় কাপুরুষতা। আইনের ছাত্র হিসেবে নিজের বিবেকের কাছে সৎ থাকার জন্য এতটুকু সৎসাহস থাকা উচিত। আমার কাছে এটা স্পষ্ট, এ হামলার ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। তার গ্রুপের নেতাকর্মীরাই আমাদের ওপর হামলা চালায়। সম্ভবত দায় এড়ানোর জন্য তিনি ফ্রন্টে পাঠান শাহবাগ থানা ছাত্রলীগ নেতা তৌহিদুল ইসলাম সুজনকে। কিন্তু তার পেছনেই ছিল ঢাবি ছাত্রলীগের নেতারা।

ভুক্তভোগীরা হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের যেসব নেতাকে অভিযুক্ত করেছেন তারা জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

ঘটনার সময় কাকতালীয়ভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছেন তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী ছাত্রলীগের জসীমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের সহ সভাপতি শাহ সুলতান অপু। তবে তিনি হামলায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

অপু বলেন, আমি সেদিন অসুস্থ ছিলাম। তাই আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে যাই। ফেরার পথে আমি সেই ঘটনা দেখতে পাই এবং সেখানে না থেমে চলে আসি। আমি সেখানে জড়িত না থেকেও কেউ আমাকে ইচ্ছে করে জড়িত করলে আমার কিছু করার নেই।

এ বিষয়ে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আকতারুল করিম রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অসুস্থ, গত রোববার আমি হল গেটে হেপাটাইটিস বি টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্টে আমার হেপাটাইটিস-বি পজিটিভ এসেছে। সেদিন থেকেই আমি বেড রেস্টে আছি। আমি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার পরও আমাকে যুক্ত করে পত্রিকায় নিউজ করা হয়েছে। আমি সুস্থ হওয়ার পর সেই প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব।

শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আরাফাত ইসলাম প্লাবন বলেন, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি অভিযোগ। আমি সেদিন সকাল থেকেই ব্যক্তিগত কাজে ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম। ইফতারের আগ মুহূর্তে আমি ক্যাম্পাসে আসি। তবুও আমার নাম হামলাকারীদের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।

অভিযুক্ত ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক নাঈমুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের সামনের ঘটনা না, ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মারামারি বা অপকর্মের সঙ্গে আমার কখনো কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। শুধু ছাত্রলীগ করি বলে কেউ আমার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলছে।

এ বিষয়ে জানতে বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপ সম্পাদক শাকিবুল ইসলাম সুজনকে কল করা হলে তিনি ইফতারের পর কথা বলবেন বলে কল কেটে দেন। ইফতারের পর আবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুরুর দিন থেকেই আইন বিভাগের সেই শিক্ষার্থীরা আমার নাম মেনশন করার চেষ্টা করছে। যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরায় কারো চেহারা স্পষ্ট না, সেখানে শুধু শুধু ৬-৭টা ছেলের নাম বলে দিয়েছে তারা। আমরা যদি তাদের বাধাই দিতাম তাহলে তাদের সেদিন বিকেলে টিএসসিতে মানববন্ধন করতে দিতাম না। তাছাড়া সেদিন আমি অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি এ বিষয়ে। তারা সবাই বলেছে, তারা শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নেতাকর্মীকে তারা দেখেনি।

তিনি আরও বলেন, আমরাও সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। আমরা সেখানে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে দেখিনি, বরং আমরা সেখানে অন্য তথ্য পেয়েছি। আমরা দু-একদিনের মধ্যে সব তথ্য-প্রমাণ গণমাধ্যমকে লিখিত আকারে দেব। অনেক আপডেট তথ্য আমরা দেব, যা তারা ঘটিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আইন অনুষদের শিক্ষার্থীদের ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান' শীর্ষক আলোচনা সভায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা করার অভিযোগ ওঠে। এতে অন্তত সাত শিক্ষার্থী আহত হন। ঘটনার পর আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় আন্দোলন করেন। পরদিন প্রক্টর, উপাচার্য ও শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগ দেন তারা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

কেএইচ/এসএসএইচ