দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা শেষে ঈদুল ফিতরের দিন প্রতিটি মুসলমানের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঈদ সব মুসলমানের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। ঈদ নিয়ে ছোট-বড় সবার মধ্যে আনন্দ-উত্তেজনা বিরাজ করে। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তাদের ঈদ ভাবনা। তাদের সবাই ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক এইচ এম খালিদ হাসান।

সবাইকে নিয়ে উৎসবের মেতে ওঠার মধ্যেই রয়েছে ঈদ পালনের সার্থকতা

সুলতানুল আরেফিন 
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
দৈনিক মানবকণ্ঠ

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার পর থেকে ঈদ উদযাপনে ভিন্নতা এসেছে। আগে সবগুলো রোজা বাড়িতেই করা হতো। সেটার অন্যরকম এক আনন্দ ছিলো। এখন প্রায় ২০টা রোজা করতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। ক্লাস, পড়াশোনা, সাংবাদিকতাসহ আনুষঙ্গিক অনেককিছু বজায় রেখেই সিয়াম সাধনায় মনোনিবেশ করতে হয়েছে। তবে বাড়িতে ফেরার পর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়া, তাদের ইফতার আমন্ত্রণে যোগদান করার মতো আনন্দগুলোও অমূল্য।

বাড়িতে এসে অনলাইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, সাংবাদিক সহকর্মী, বন্ধু, অগ্রজ, অনুজদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা হচ্ছে কিছুটা। ছোটদের সালামি দেওয়া এবং বড়দের থেকে সালামি নেওয়ার মতো বিষয়গুলো ভার্চুয়ালি আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা বৃদ্ধি করছে। আগে হয়তো এক জায়গায় থাকলে আরেক যায়গার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করা যেত না। কিন্তু অনলাইনের বদৌলতে বাড়িতে এসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে সুন্দরভাবে ঈদস্মৃতি ভাগ করে নিচ্ছি। 

সময় যাচ্ছে, আমাদের সবারই দায়িত্ব বাড়ছে। কিন্তু দায়িত্ববোধ যেন ঈদের আনন্দ উপভোগের পথে বাঁধা সৃষ্টি না করতে পারে, এদিকটা সবসময় বিবেচনায় রাখি। ঈদ মানেই আনন্দ, খুশি। আর এই আনন্দকে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়াতেই আমাদের সার্থকতা। অসহায় দুঃখী মানুষের পাশে যদি আমরা সবাই দাঁড়াতে পারি, তাহলে ঈদের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যাবে। যেহেতু ঈদ কোনো একক উৎসব নয়, এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক উৎসব। তাই, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এই উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার মধ্যেই রয়েছে ঈদ পালনের সার্থকতা। 

ঈদ সেদিনই আনন্দময় হবে যেদিন দারিদ্র্য-অসচ্ছল মানুষের মুখে অকৃত্রিম হাসির রেখা দেখতে পাবো 

শেখ সাদী ভূঁইয়া 
ফিশারীজ এন্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগ 
যবিপ্রবি প্রতিবেদক
দৈনিক যায়যায়দিন

রমজান এলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের আবেগ-উত্তেজনা বিরাজ করে। কখন ক্যাম্পাস বন্ধ দেবে, একাডেমিক ক্যালেন্ডারে দেওয়া বন্ধের আগে কিভাবে বাড়ি যাওয়া যায় সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। বাড়ি গিয়ে কি করবো সেটারও একটা প্লান করে ফেলি। পরিবারের টানে প্রত্যেকবারই ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার কয়েকদিন আগেই বাড়ি চলে আসি। অল্প কয়েকদিনের ছুটির মাঝে সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, কুশল বিনিময়, বাল্যকালের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, ছোটবেলার স্মৃতিচারণ, প্রভৃতির মাধ্যমে ঈদের ছুটি কাটাতে চাই।

মনে পড়ে ছোট্ট বেলায় মা-বাবা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের কাছে ঈদের সালামি চাওয়াটা এখন শুধুই স্মৃতি। যদিও নতুন প্রজন্মের মাঝে এটা এখন দেখা যায় না। নতুন প্রজন্মের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে ঈদে দিনগুলোতে ভার্চুয়াল জগত থেকে বের হয়ে অকৃত্রিম ভালবাসা ছড়িয়ে দিক পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে।

ঈদে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আরেকটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে হয়, সমাজের অসচ্ছল মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এছাড়া যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে নিজেদের ন্যায্য পারিশ্রমিকটুকু না পেয়ে ঈদের দিনও একরাশ দুঃখ নিয়ে ঈদ উৎযাপন করে তাদের পাশে দাঁড়ানো। আমার ঈদ সেদিনই আনন্দময় হয়ে উঠবে যেদিন দারিদ্র্য-অসচ্ছল ও শ্রমিক ভাইদের মুখে ঈদে অকৃত্রিম হাসির রেখা দেখতে পাবো। সব মিলিয়ে একটা বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ ও রাষ্ট্র চাই।

বর্তমান প্রজন্মের ঈদ এখন অনলাইন কেন্দ্রিক 

মো. মিরাজুল ইসলাম
ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন বিভাগ
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
সময় জার্নাল, রূপান্তর প্রতিদিন

ঈদ মানেই ক্যাম্পাস ছুটিতে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠা। পড়ালেখা, টিউশনি ও নানান কর্মব্যস্ততা থেকে অবসাদ দেয় ঈদের ছুটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোড়কে বেষ্টিত গ্রামের নানা চিত্র অবলোকনে সতেজতা ফিরে পাই। চাঁদরাতে বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করা, পটকা ফাটিয়ে মহল্লাকে মাতিয়ে রাখা। খুব ভোরে উঠে গোসল করে নতুন পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে যাওয়া। ঈদের নামাজ শেষে বন্ধুদের বাসায় খাস্তা খাওয়া, বিকেলে দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া ও ঈদ পরবর্তী পুনর্মিলনীর পরিকল্পনা করা। এরই মাধ্যমে আমাদের শৈশবের স্মৃতিচারণ হয়৷ 

তবে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সমতা বজায় রাখতে প্রযুক্তির মোড়কে আমরা নিজেদের আটকে রেখেছি অনেকটাই৷ যত বড় হচ্ছি দিনদিন বন্ধুদের সংখ্যা কমছে, ঈদ উদযাপনের আগ্রহ শেষ হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মও এখন আর আড়ম্বর পূর্ণভাবে ঈদ উদযাপন করে না। তাদের ঈদ উদযাপনও এখন অনলাইন কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কেউ এখন ঘুরতেও বের হয় না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতেও ঈদ আনন্দ উপভোগ করে না। অনলাইনেই সকলের খোঁজ খবর নেওয়াতেই অনেকটা সীমাবদ্ধ বর্তমান তরুণদের ঈদ আনন্দ। 

বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে ঈদ আনন্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছে

মো. কামরুজ্জামান পুলক 
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক 
সময়ের আলো

দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পরে সেই কাঙ্ক্ষিত ঈদ। ঈদের দিনকে ঘিরে আমাদের সকলের কত স্বপ্ন, কল্পনা, আনন্দ বিলানোর স্মৃতি থাকে। রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শেষে আসে ঈদুল ফিতরের আনন্দ বার্তা। ঈদের আনন্দ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, এটি সামাজিক উৎসব। সবার মাঝে সুখ, দুঃখ শেয়ার করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ঈদ-উৎসবের বৈশিষ্ট্য।

রোজা পালনের মাধ্যমে আর্ত-পীড়িত-বুভুক্ষু মানুষের কষ্ট যেমন উপলব্ধি করা যায়, ঈদ-উৎসবে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়াকেই ঈদের শিক্ষা বলা যায়। ফেৎরা-জাকাত ধনীদের অবশ্যই প্রদেয়। তবে জাকাত দিতে হবে নীরবে-নিভৃতে, ঢাকঢোল পিটিয়ে লোক জড়ো করে নয়। এতে দারিদ্র্যের অভাব ঘুচানোর পাশাপাশি মন ও সম্পদের পরিশুদ্ধতাও অর্জিত হয়।

ঈদ মানুষের জীবনে অনাবিল আনন্দ আর সুখ নিয়ে আসে। কিন্তু এই ঈদ আনন্দ এখন আর ঠিক আগের মতো সবার কাছে উপভোগ্য হয় না, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের আনন্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছে সময়ের গহ্বরে নীরবে-নিভৃতে। আনন্দগুলো শুধু ছোটদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ছোটবেলায় ঈদ আসার এক সপ্তাহ থেকে মনের মধ্যে নতুন জামা-কাপড় আর কত সব রঙিন স্বপ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত। ঈদের দিন কি করবো কি করবো না, কোথায় ঘুরতে যাবো, কত পরিকল্পনা। এখন এসব শুধু কল্পনায় আসে বাস্তবে আর হয় না।

ঈদের দিনের মতো বাকি দিনগুলোও আনন্দময় হয়ে উঠুক

রাসেল হোসেন 
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ
বশেমুরপ্রবি প্রতিবেদক
দৈনিক সংবাদ

রমজান মাস মুসলমানদের ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস। দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনার পর খুশির আমেজ নিয়ে আসে ঈদ। ঈদে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেকড়ের টানে নিজ এলাকায় ছুটে আসে সবাই। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করার মাধ্যমেই ঈদ স্মৃতি উপলব্ধি করা যায়। ঈদ মানে আনন্দ, তবে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করলে ঈদের আনন্দ আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। এক মাস রোজা রাখার পর আসমানি তাগিদে নিজেকে বিলিয়ে দিতে যাকাত ও ফেতরার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে; ঠিক তেমনিভাবে গরিব, নিঃস্ব, এতিমদের হক আদায় করে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। সমস্ত ব্যস্ততা, ক্লান্তি আর বাকি দিনগুলোর কষ্টের কথা ভুলিয়ে দিতেই যেন উদয় হয় ঈদের দিন।

তাছাড়াও সকলে মিলে একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়া, মহান আল্লাহ তালার শুকরিয়া আদায় করা, খানাপিনা, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার মধ্য দিয়েই দারুণভাবে কেটে যায় ঈদের দিনটা। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ঈদের খুশিটা ভাগাভাগি করে নিতে চাই আমরা সকলেই। আর এই ঈদের দিনের আনন্দের মুহূর্তগুলোর মতো যেন আমাদের বাকি দিনগুলোও আনন্দের হয়ে ওঠে এটাই প্রত্যাশা। 

কেএইচ/এমএসএ