গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক বছরের বেশি সময় পার হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হয়নি। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বুধবার (৫ মে) ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে ডিনস কমিটির জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. হাসানুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় সেশনজট তৈরি হবেই। এর প্রভাব কমাতে ডিনস কমিটির জরুরি বৈঠকে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। জুলাই মাসের মধ্যে যদি সশরীরে পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তাহলে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টায় নেওয়া হবে।’

তবে অনলাইন পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

অনার্স শেষ বর্ষ এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা অনলাইন বা যেকোনো ধরনের পরীক্ষার পক্ষে। কেননা তারা চাকরিতে প্রবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে, নিচের দিকে অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পরীক্ষার পক্ষে নন। কারণ হিসেবে তারা নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন।

অনলাইন পরীক্ষার পক্ষে থাকা শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বড় ধরনের সেশনজটে পড়তে যাচ্ছেন তারা। বর্তমান চাকরির বাজারের জন্য এখনই নিজেদের প্রস্তুত করা প্রয়োজন। ফলে তাদের দ্রুত ক্লাস ও পরীক্ষা শেষ করা দরকার।

সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশিদাতুল রোশনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমরা যারা শেষ বর্ষে আছি, আমাদের কিন্তু পরীক্ষা নিলেই আমরা মোটামুটি চাকরির দিকে যেতে পারব, পরিবারের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব। আমাদের বিভাগে ৮ম সেমিস্টারে মোটামুটি ২০ দিনের রুটিনেই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। এই পরীক্ষা স্যারদের যেভাবে ইচ্ছা নিক, কিন্তু নিতে হবে। আমরা যারা শেষ বর্ষে আছি তাদের জন্য পরীক্ষা হওয়াটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিম হাসান আবির বলেন, ‘করোনা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। ফলে ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়েছে। করোনা সম্প্রতি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে অদূর ভবিষ্যতে কবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে সে নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমতাবস্থায় অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক।’

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মো. ইউনুস বলেন, ‘অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলে অবশ্যই নেওয়া উচিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের একাডেমিক কার্যক্রম থামিয়ে রাখেনি, তাদের পরীক্ষা চলমান রয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর এক দিন করে লস হলেও হাজার হাজার দিন লস। সুতরাং, এক বছরের বেশি সময় অলরেডি নষ্ট হয়ে গেছে। এবার বিষয়টি বিবেচনায় আনার সময় হয়েছে।’

অন্যদিকে, অনলাইন পরীক্ষার বিরোধিতাও করছেন কিছু শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা গ্রামে অবস্থান করার কারণে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে একটি দীর্ঘ বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে, অনেকেই ঝরে পড়তে পারেন। 

ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নুরুল আবসার বলেন, ‘যেখানে চার ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থী নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করেননি নেটওয়ার্ক কভারেজ ও অন্যান্য অসুবিধার কারণে। সেখানে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে, একজন সহপাঠী আধাঘণ্টা চেষ্টা করেও কানেক্ট হতে পারছেন না। কিংবা আরেকজনের পরীক্ষা চলাকালীন ওয়াইফাই ডাউন অথবা কারেন্ট চলে গেছে। জোড়াতালির নেটওয়ার্কে কোনোরকমে ক্লাস করা গেলেও অনলাইন পরীক্ষা কীভাবে সম্ভব? সশরীরে যদি একান্তই পরীক্ষা না নেওয়া যায়, তবে সেটা হোক অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে।’

ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মারুফ হোসেন শাহীন বলেন, ‘ডিভাইস এবং নেট প্রব্লেমের কারণে আমরা অনেকে এমনিতেই অনলাইন ক্লাস করতে পারিনি। সেক্ষেত্রে অনলাইনে পরীক্ষা কীভাবে সম্ভব? যদি অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হয়, আমাদের বঞ্চিত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর মেক-আপ ক্লাস নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হলে আমরা সবাই উপকৃত হব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী জয় পাল বলেন, ‘অনলাইনে কো‌নো পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। যেখানে ক্লাসই করতে পারি না, সেখানে আবার পরীক্ষা! যা হবে সরাসরি হবে। পরীক্ষা নিতে চাইলে সরাসরি নিতে হবে। এমনিতেই অনলাইন ক্লাসের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আর না। ভ্যাকসিন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে তারপর সংক্ষিপ্ত সিলেবাস করে নতুন করে ক্লাস নিয়ে পরীক্ষা হবে। এর আগে না।’

এইচআর/এফআর/জেএস