করোনাভাইরাসের ভয়কে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জয় করে এক জমিতে একাধিক ফসল চাষ করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির পাশাপাশি সফলতা পেয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ। 

শাকিল আহমেদ টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া ইউনিয়নের গোমজানি গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে। তার সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আশপাশের কৃষক পরিবারের যুবকরাও চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে ওঠছেন।

শাকিল আহমেদ এক জমিতে শসা, ব্ল্যাকবেরি তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করে সফল হয়েছেন। এক জমিতে তিন ফসলের ফলন ভাল হওয়ায় এলাকায় সাড়া ফেলেছে।

শাকিল আহমেদ বাড়ির পাশের ছিলিমপুর এমএ করিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০১৪ সালে টাঙ্গাইল শহরের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি শেষ করেন। ২০২০ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কৃষি বিভাগ থেকে বিএসসি শেষ করেন।

শাকিল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় প্রথম লকডাউনে পরিবারের সঞ্চয় করা অর্থ শেষ হয়ে যায়। পরিবারে অর্থনৈতিক মন্দা, টানাপোড়েন সবকিছু মিলে নতুন কিছু করার কথা ভাবতে থাকি। লকডাউন শিথিলের পর বেসরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা শুরু করি। কয়েকটি মার্কেটিং কোম্পানি এবং বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাডমিনে চাকরির জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিই। মৌখিক পরীক্ষার পর বেতন, কাজের চাপ এবং সময় জানার চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে নিজে কিছু করার কথা ভাবতে থাকি।

কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বসতবাড়িতে সবজি চাষ এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার প্রজেক্টের কথা মাথায় আসে। ইউটিউবে কৃষি বিষয়ক চ্যানেলের ভিডিও থেকে স্কোয়াশ, শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বাবাকে জানাই। বাবার আশ্বাস পেয়ে ভিন্ন উপায়ে চাষাবাদ করার কথা চিন্তা করি।

তিনি আরও বলেন, কম পরিশ্রমে অধিক ফলনের লক্ষ্যে ভারত থেকে আনা উন্নত প্রযুক্তিতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করি। ফলে জমিতে অতিরিক্ত কোনো শ্রমিকের প্রয়োজন পড়েনি। প্রথমে স্কোয়াশ চাষ করে সফল হই। এরপর শসা, তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করি। ৪৫ শতাংশ জায়গার মধ্যে ১২ শতাংশে শসা, ১৫ শতকে তরমুজ বাকি জায়গায় বাঙ্গি চাষ করেছি। এ প্রজেক্টে ১৮ হাজার টাকা খরচ হলেও ইতোমধ্যে গত ১৪ দিনে প্রায় ৫০ হাজার টাকার শসা বিক্রি করেছি। এ ছাড়া প্রতিদিন সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার শসা বিক্রি হচ্ছে।

সোমবার (১৭ মে) থেকে বাজারে তরমুজ বিক্রি করা শুরু করেছি। ঈদুল ফিতরের আগে বাঙ্গি বিক্রি করা হয়েছে।  এ ছাড়া চারদিকে নেট দিয়ে বেড়া দিয়ে করলা ও ধুন্ধলের চাষ করা হয়েছে। বাঙ্গি ও তরমুজের বেডের ফাঁকা জায়গায় লাল শাক ও ডাটা চাষ করেও পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন বলে জানান। 

শাকিল বলেন, ‘উইনডো মাচাং’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় পরিচিত ও আত্মীয়দের কাছ থেকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আশেপাশের গ্রামসহ আতিয়া এলাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পুরোপুরি নতুন ধারণা। আগে কখনও তারা এটি দেখেনি। এটা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পরও সমালোচকরা তাকে ‘পাগল’ উপাধি দিয়েছে।

গোমজানি গ্রামের জাহিদুর রহমান, শহর আলী ও সেলিম আহমেদ জানান, এক সময় তাদের গ্রামে শুধু ধান চাষ করা হতো। আগে কখনও তরমুজ চাষ করা হয়নি। সবজি চাষের কোনো চিন্তাও ছিল না। শাকিলের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ দেখে প্রথমে পরিহাস করলেও এখন তার সফলতা দেখে তারা গর্বিত। তারা শাকিলের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তার মতো চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার চাষ পদ্ধতি দেখতে অনেক দূর থেকে লোক আসে বলেও জানান তারা।

গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করার স্বপ্ন দেখা শাকিল বলেন, বসতি জমি বাড়ছে। তবে কৃষি জমি দিন দিন কমছে। কৃষি নিয়ে বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষি নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছা তার। তিনি এবং তার ৩-৪ জন বন্ধু মিলে এই কাজটি করতে চান। কীভাবে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়- তা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দালাল, ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে কীভাবে পৌঁছানো যায় তা নিয়েও কাজ করবেন তিনি। আগামী বন্যার আগে আরেকবার সবজি চাষ করা হবে। বন্যায় কচুরিপানার ওপর সবজি চাষ করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।

শাকিলের বাবা আব্দুল করিম জানান, গত মার্চে যখন শাকিল স্কোয়াশ চাষ করে, তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কৃষিকাজ করে এমন অনেক বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য শুনতে হয়েছে। তারাই এখন পরামর্শ নিতে আসে। শাকিলের প্রজেক্টে ফসলের ফলন দেখে আমি মুগ্ধ। এমন সন্তানের বাবা হওয়ায় নিজেকে গর্বিত মনে হয়।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে শাকিল গ্রামীণ কৃষির চাষাবাদে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তার সাফল্য দেখে স্থানীয় কৃষকরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছে। শাকিলের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করি।

এসপি