সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক এম সাইদুর রহমান খান। ক্ষমতার পালাবদলে ২০০১ সালে বিএনপি এলে তাকে সরিয়ে ড. ফাইসুল ইসলাম ফারুকীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

পরবর্তী ২২ বছরে আর সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। চলতে থাকে প্যানেল এড়িয়ে অনির্বাচিতদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগদান। এক্ষেত্রে প্যানেলের জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে উপাচার্য প্রার্থী শিক্ষকদের তদবির তৎপরতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকরা দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তদবির-তোষামোদকে অনেকাংশে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, সিনেটের প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে সজ্জন ও প্রশাসনিকভাবে কঠোর শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু প্যানেল নির্বাচন না হওয়ায় উপাচার্য নিয়োগে এখন তদবির এবং তোষামোদই বড় যোগ্যতা হয়ে উঠছে। ফলে যেসব শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তারা নিজেদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভেবে পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়।

৭৩ এর অধ্যাদেশ কী বলছে? 

৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট নির্বাচিত প্যানেল থেকে উপাচার্য নিয়োগের কথা থাকলেও অধ্যাদেশকেই বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে বছরের পর বছর। ছাত্র প্রতিনিধি (রাকসু) নির্বাচন না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ কার্যকারিতা হারিয়েছে সিনেট।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারা অনুযায়ী, উপাচার্য নিয়োগে ৩ সদস্যবিশিষ্ট প্যানেল নির্বাচনের দায়িত্ব সিনেটের। সিনেট নির্বাচিত ওই তিনজনের একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি একজনকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন।

আবার ১১ (২) ধারায় বলা আছে, যদি অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্যকোন কারণে উপাচার্য পদ খালি থাকে, তাহলে তা পূরণে রাষ্ট্রপতি (যা ভালো মনে করবেন) ব্যবস্থা নিবেন।

অসম্পূর্ণ আর অকার্যকর সিনেট : 

অধ্যাদেশ মেনে সিনেট হলে সেখানে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ৫ জন গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতি তথা আচার্য মনোনীত ৫ জন শিক্ষাবিদ, সরকার মনোনীত ৫ জন সরকারি কর্মকর্তা, স্পিকার মনোনীত ৫ জন সংসদ সদস্য, ৫ জন অধিভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষদের প্রতিনিধি, ৫ জন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি এবং ৫ জন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিসহ মোট ১০৫ জন সদস্য নিয়ে সিনেট গঠন হওয়ার কথা।

সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে সিনেটের সুপারিশে উপাচার্য নিয়োগ পান অধ্যাপক এম সাইদুর রহমান খান। ২০০১ সালের ১২ নভেম্বর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে সিনেট সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে সে অচল অবস্থা ভাঙেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন। ২০১৫ সালের ১৮ মে সিনেট অধিবেশন বসে। অধ্যাপক মিজানের সময়ে ২০১৬ সালের ১৯ মে দ্বিতীয় দফায় সিনেট অধিবেশন বসে। অধিবেশনে বার্ষিক বাজেট প্রস্তাব, সিন্ডিকেটে পাস করা আইন অনুমোদনসহ বিভিন্ন বিষয়ের এজেন্ডা থাকলেও উপাচার্য নির্বাচনের কোন এজেন্ডা ছিল না।

২০১৭ সালের ৭ মে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক আবদুস সোবহান। তার সময়ে সিনেটের কোন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়নি। মাঝে অধ্যাপক মিজানের সময়ের ২ দফা বাদ দিলে ১৯৯৯ সালের পর থেকে সিনেট এড়িয়ে বিশেষ ক্ষমতায় চলেছে রাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, উপাচার্য বছরে অন্তত একবার সিনেটের সভা ডাকবেন, যা বার্ষিক সভা হিসেবে অভিহিত হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ আছে। যা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। আমি সর্বশেষ সেই আইনেই নির্বাচন দিয়ে এসেছি ১৯৯৯ সালে। প্রতি ৪ বছর পর পর নিয়োগ সেভাবেই দেওয়ার কথা। সেটি আর হয়নি। গত ২২ বছর উপাচার্য সিনেট প্যানেল থেকে আসেনি। এটি হলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো না, যেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি।

সিনেট এড়িয়ে বিশেষ ক্ষমতায় চলা সুস্থ সংস্কৃতি নয় জানিয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও নির্বাচিত সিনেট সদস্য ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, সিনেটের যে বিষয়গুলো আলোচনা হওয়া দরকার সেসব নিয়ে প্রশাসনের কোনো অস্বস্তি আছে বলেই সভা হচ্ছে না। নিয়মকানুনগুলো করা হয়েছে যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো চলে। সেগুলোকে উপেক্ষা করা ও বিশেষ ক্ষমতার ব্যবহার কোনো সুস্থ সংস্কৃতি নয়।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, নানা রাজনৈতিক কারণে সিনেটকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। সিনেটে অনেক সময় উপাচার্যদের কাজের সমালোচনা হয়। তাই সিনেট করে কেউ সমালোচিত বা প্যানেল করে হারতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন উপাচার্য যদি মনে করেন তাহলে যেকোন সময় এটি কার্যকর করা সম্ভব।

২০০১ সালের পর থেকে উপাচার্য নিয়োগের এই ধারা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অধ্যাপক ফাইসুল ইসলাম ফারুকী, অধ্যাপক আলতাফ হোসেন, অধ্যাপক আব্দুস সোবহান ও অধ্যাপক মুহম্মদ মিজান উদ্দিন উপাচার্যের দায়িত্ব পান। তারা সবাই রাষ্ট্রপতি মনোনীত উপাচার্য।

সর্বশেষ অধ্যাপক আব্দুস সোবহান গত ৬ মে উপাচার্য হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষ করেছেন। অসম্পূর্ণ সিনেট নিয়ে এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। এ অবস্থায় আবারও নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতিই পুনরায় নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিবেন বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।

এসপি