ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় মানেই ক্লাস-পরীক্ষা আর অ্যাসাইনমেন্টের ব্যস্ততা। অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-গান আর হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠা। তবে ক্যাম্পাস জীবনের এ চিরচেনা রূপটাতে ছেদ টেনেছে করোনা পরিস্থিতি। বৈশ্বিক এ মহামারির কারণে গেল বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। 

অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। খালি করা হয় ১৭টি আবাসিক হল। মাত্র ১০ দিনের ছুটির দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠালেও দিন, সপ্তাহ, মাস শেষ করে বছর ছুঁইছুঁই সে ছুটি। 

যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের জুলাই থেকে শুরু হয়েছে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম। থেমে নেই এর নিয়মিত দাফতরিক কার্যক্রমও। তবে ক্যাম্পাসের সে কোলাহলময় চেনা রূপে ফিরতে এখনও হয়তো গুনতে হবে বেশ কিছু দিন।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর ক্যাম্পাস এখন জনমানবহীন। ক্যাম্পাসের ইবলিশ চত্বর, স্টেশন বাজার, টুকিটাকি, জোহা চত্বর বা রোকেয়া হলের বটতলা কোথাও জনমানুষের চিহ্ন নেই। 

গগণশিরিষঘেরা প্যারিস রোডেও আজ শুধুই শূন্যতার হাহাকার। বন্ধ ক্যাম্পাসে থেমে গেছে প্যারিস রোডের চিরচেনা আনাগোনাও। পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর দেখা মিলল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনের পরিবহন মার্কেটে। যেন পুরো রাবি গুটিয়ে গেছে আমতলায়। তবে দীর্ঘ নয় মাসের এ অবসর শেষে এবার শিক্ষার্থীরা ফিরতে চান প্রিয় ক্যাম্পাসের আঙিনায়। সে রকম আকুলতায় মাখা আবেগ আর মানসিক পীড়ায় জর্জরিত কথা শোনা গেছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। 

গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিঠুন চন্দ্র মোহন্ত মুঠোফোনে বলছিলেন, যে সময়টা চারুকলা, এনামুল ভাইয়ের দোকান, ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল, এখন ঠিক উল্টো।  চার দেয়ালের মাঝে কত কঠিনভাবে একেকটা দিন কাটাতে হচ্ছে, এর চেয়ে আক্ষেপ আর কি হতে পারে।  

গবেষণা, মানসিক সুস্থতা, চাকরির প্রস্তুতি, টিউশন, সেশন এগিয়ে নেয়া সব মিলিয়ে হিসাবের খাতায় হতাশার ছাপ। মোহন্ত বলেন, অসংখ্য শিক্ষার্থী একাকিত্ব এবং মানসিক বিষন্নতায় কিংবা আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন এই কঠিন সময়ে। যখন কিনা তাদের পাশে দাঁড়াবার কথা ছিল বিভাগের শিক্ষক, বড় ভাই-বোন কিংবা সবচেয়ে কাছের বন্ধুটার, হয়তো সেটাও সম্ভব নয় আজ।

এতো কিছুর পরও আশাবাদী তিনি। গগণশিরিষের রাস্তায় আবার হয়তো দেখা হবে আমাদের। চিরচেনা ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো, ল্যাব, ক্লাসরুম, কাঠবিড়ালির দুরন্তপনা কিংবা শেষ বিকেলের পদ্মাপাড়ে লাল আভা ছাড়ানো সূর্যাস্ত দেখবার জন্য হলেও এ কয়টা দিন বাঁচতে চাই। মানুষ হয়তো এভাবেই কঠিন সময়গুলো শুদ্ধ স্বপ্ন আঁকড়ে বেঁচে থাকে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী শাওন শাহনাজ রহমান বলেন, গত বছরের মার্চ থেকেই ভাবছি এই তো আর কয়টা দিন, তারপরই ফিরব ক্যাম্পাসে। কিন্তু এই হতাশা নিয়েই একটা বছর চলে গেল। ক্যাম্পাসকে কতটা মিস করছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। হতাশা থেকে আমার বয়সী অনেকেই আত্মহত্যার মত ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর এমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে অনেক। আমি চাই দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক।

উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী সিরাজুম মুনিরা তামান্না বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকাই জীবন স্থবির হয়ে গেছে। সশরীরে ক্লাস করব, পরীক্ষা দেব এবং অবসর সময়ে প্যারিস রোড, ইবলিশ চত্বর, জোহা চত্বর, টুকিটাকিসহ আরও বিভিন্ন জায়গায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব। সব এখন স্মৃতি। সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ক্যাম্পাস খোলার অপেক্ষায় দিন গুণছি। সময় যেন ফুরাতেই চাইছে না।

হতাশ হয়ে কেউ কেউ আত্মহননের মতো পথ বেঁচে নিচ্ছে উল্লেখ করে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাবি শাখার সভাপতি মোরশিদুল আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার সার্কুলার কিন্তু চলমান। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্য হতাশা কাজ করছে। পরীক্ষা ক্লাস চালু থাকলে তাদের এই হতাশা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো। বিগত এক মাসেই প্রায় ৫/৬ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরও একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। 

হল খুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হচ্ছে আবাসিক হল।  তারা হলে এসে নিয়মিত পড়াশোনা করলে হয়তো তাদের অনেকাংশে হতাশা কেটে যাবে। পরীক্ষাগুলো দিতে পারবেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় মেসে উঠতে নানা রকম শর্ত দিচ্ছে।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। করোনার প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে শীতের এ সময়টিতে। ইতোমধ্যে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নিদের্শনা দিয়েছে সরকার।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান বলেন, আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন বাড়ি গিয়ে এক মাসও থাকতে পারতাম না, কষ্ট হতো। কিন্তু তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাড়িতে আছে। জানি তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে পারি না। এখন যদি ক্যাম্পাস খুলে দেই, অল্প একটু জায়গার মধ্যে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী থাকবে। বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা আসবে। কে করোনা পজেটিভ, কে নেগেটিভ সেটা তো জানা নেই। এতে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। একটু স্বাভাবিক হলেই  সরকারের নির্দেশনা পেলে আমরা খুলে দিব।

এসপি