নেকাব না খুলে শনাক্তকরণ পদ্ধতি চালুর দাবি ঢাবি ছাত্রীর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন এক নারী শিক্ষার্থীকে পরিচয় যাচাইয়ে নেকাব খুলতে বলা হয়। কিন্তু নারী শিক্ষার্থী নেকাব না খুলতে চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান ‘দেশটা যে কী হচ্ছে, নরক হয়ে গেছে দেশটা’ বলে মন্তব্য করেন।
এ ঘটনার জেরে ‘নেকাব না খুলেই’ আইডেন্টিটি যাচাইয়ে সিস্টেমের পরিবর্তন আনার জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ব্যবহার, ইতোপূর্বে হওয়া ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে সব নিপীড়কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ তিন দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি জানান ওই নারী শিক্ষার্থী। এসময় বিভাগের কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে সিস্টেম পরিবর্তনের দাবি জানান তিনি।
ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী তাহমিনা তামান্না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
তার দাবিগুলো হলো–
১. অনতিবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা ও ভাইভায় সনাতনী পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের চেহারা দেখে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করতে হবে।
২. বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করার পূর্ব পর্যন্ত নারী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও ভাইভায় নারী শিক্ষকের মাধ্যমে শনাক্ত করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. ইতোপূর্বে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘটিত প্রতিটি নিপীড়ন ও হেনস্তার যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে সব নিপীড়কের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তামান্না বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) আমার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়েছে। আজ পরীক্ষা শুরুর পর স্যার খাতা সাইন করার সময় আসছেন। আমাকে অ্যাটেন্ডেন্স শিটে সাইন করতে দিয়ে মুখ খুলতে বলছেন। আমি আসলে কীভাবে না করব এটা বুঝতে পারছিলাম না। তাই দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করেছিলাম। স্যার বলছেন ‘বসো, বসে মুখ খুলো, চেক করতে হবে তো আমার।’ আমি মাথা নিচু করেই ছিলাম। আমার হাত কাঁপছিল। স্যার পরে বললেন ‘কোনো সমস্যা?’ আমি বলছি জি স্যার। পরে স্যার বলছেন ‘মুখ খুলবে না?’ আমি আস্তে করে বলছি জি না স্যার। তখন স্যার আমার থেকে অ্যাটেন্ডেন্স শিটটা নিয়ে আমার খাতাটা সাইন না করে দিয়ে দেন। বলেন ‘ঠিক আছে রাখো তোমারটা একটু পর সাইন করতেছি।’
‘‘আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা ঝামেলা হবে। লিখতে পারছিলাম না। দেখলাম স্যাররা সামনে বসে আলোচনা করছে। আমি বুঝছি আমার কথাই বলছে। একটু পর চেয়ারম্যান স্যার উঠে আসেন। আমার পেছন থেকে ম্যাম দাঁড়ান এসে। তারপর আমাকে ম্যাম বলেন যে ‘কী ব্যাপার কোনো সমস্যা? স্যারকে সাইন করাতে দাও নাই কেন? কোনো সমস্যা? মুখ দেখাবে না?’ ম্যাম ভালো করেই জিজ্ঞেস করেছিলেন।’’
এসময় চেয়ারম্যান ‘দেশটা যে কী হচ্ছে, নরক হয়ে গেছে দেশটা’ বলে মন্তব্য করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার সারা শরীর কাঁপছিল কারণ আমি অত সাহসী মানুষ না। মাথা নিচু করে ছিলাম। তখন ম্যাম বলেন ম্যামকে দেখাতে। আমি এক পাশ ফিরে ম্যামকে দেখাই। পরে ম্যাম সাইন করেন। পাশাপাশি অনেক কিছু বলছিলেন। ম্যাম বললেন সবসময় তো মহিলা টিচার থাকবেন না। তখন চেয়ারম্যান স্যার বলেন ‘ওকে জিজ্ঞেস করেন তো ও ভাইভাতে কী করবে?’ তখন ম্যাম আমাকে বলেন, ‘ভাইভাতে কী করবে? মুখ খুলবে না?’ আমি মাথা নিচু করে ‘না’ বলি। তখন ম্যাম বলেন যে ভাইভা বোর্ডে তো মহিলা টিচার নাও থাকতে পারেন তখন? পরে চেয়ারম্যান স্যার বলেন, ‘ওর জন্য কি অন্য টিচাররা সব ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে যাবে? ও মুখ খুলবে না তাই চলে যাবে বের হয়ে? দেশটা যে কী হচ্ছে, নরক হয়ে গেছে দেশটা।’
এসময় বিভাগের নারী শিক্ষক তাকে সান্ত্বনা দেন উল্লেখ করে তামান্না বলেন, আমার অলরেডি তখন চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তখন ম্যাম আমাকে বোঝাতে থাকেন ভালো করে যে ‘পরীক্ষার তো একটা নিয়ম আছে। তুমি সেকেন্ড ইয়ার না? নিয়ম জানো না?’ তখন ম্যাম আবার বলেন, ‘আমিও স্টুডেন্ট লাইফে মুখ ঢেকে রাখতাম কিন্তু পরীক্ষার হলে আমাকে বলতে হতো না, আমি খুলে রাখতাম। একটা নিয়ম তো আছে, চেক করতে হবে তো।’ পরে ম্যাম কতক্ষণ বুঝালেন। বললেন ‘আরে এ তো কান্নাকাটি শুরু করছে। নার্ভাস হইয়ো না। এ ঘটনার প্রভাব যেন পরীক্ষায় না পড়ে। এখন পরীক্ষা দাও, আমরা এ বিষয়ে পরীক্ষার পর কথা বলব।’
‘উনারা চলে যাওয়ার পরও কান্না আসছিল। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। লিখতে পারছিলাম না। পরীক্ষা কেমন হয়েছে সেটা আর না বলি। সত্যি কথা বলতে আমি জানতাম ঝামেলা হবে।’
এই অভিযোগ কোনো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে না– উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার আসলে টিচারদের নিয়ে কিছু বলার নেই। কারণ উনারা বারবারই নিয়মের কথা বলেন। আর এটা সত্যিই যে নিয়মের মধ্যেই আসল ঝামেলাটা। আমি চাই নিয়মটা চেঞ্জ হোক। একটা বিষয় বলি আমার টিচারদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আমি চাই সিস্টেমটা পরিবর্তন হোক। কোনো টিচারের কিছু হোক সেটা চাই না। না হয় নেক্সট পরীক্ষায়ও এটা ফেইস করা লাগবে, ভাইভাতেও।
‘আমি শুধু চাই ভার্সিটির সব ডিপার্টমেন্টে ক্লাসে, পরীক্ষা, ভাইভা, টিউটোরিয়ালে যারা হিজাব-নেকাব পরে তাদের কোনো সমস্যা যেন আর না হয়। চেক করার জন্য যেন অন্য কোনো ওয়ে রাখা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এটার একটা সমাধান হওয়া উচিত সেন্ট্রালি। আমি আমার বিভাগের দোষ দেব না। পরীক্ষার নিয়মটাই চেঞ্জ হোক। হিজাব-নেকাব পরা আমারসহ প্রত্যেকটা মেয়ের স্বাধীনতা হোক।’
তিনি বলেন, আমরা আগে বলতে পারতাম না। ৫ আগস্টের পরে আমরা বাক স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। তাই আমি এটা নিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেই। পরে আমি ফেসবুক আইডি ও শিক্ষার্থী সংসদে পোস্ট দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি হিজাব-নেকাব পড়লে তাদের হেনস্তা করা হয়। আমি চেয়েছি এটার যেন সুষ্ঠু সমাধান হয়।
‘আমরা এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে আইডেন্টিটি যাচাই করি। আমরা চাই সবকিছুতে যেহেতু আমরা এগিয়ে গেছি সেহেতু এখানেই আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হোক। আমার অভিযোগ শিক্ষক বা বিভাগের প্রতি নয়। আমার সমস্যা সিস্টেম নিয়ে। আমি চাই গোড়া থেকে বিষয়টি সমাধান হোক।’
সংবাদ সম্মেলনে তামান্নার ভাই আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আমির ফয়সাল বলেন, আমরা কোনো আল্টিমেটাম দেব না। বিশ্ববিদ্যালয় এমনিতেই অনেক সহনশীল। তাই আশা করব তারা এ বিষয়ে সমাধান বের করবেন। আমরা উপাচার্য স্যারের কাছে আবেদন জানাব এ বিষয় যেন স্ট্রংলি দেখেন এবং ব্যক্তি শনাক্তকরণের আইন সিনেটে উত্থাপন করেন।
তিনি বলেন, রাস্তায় ওড়না পড়তে বলা যেমন ক্রাইম তেমনই নেকাব খুলতে বলাও ক্রাইম। ওড়না পড়তে বলায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিন্তু অসংখ্যবার হিজাব-নেকাব খুলতে বলার পরও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরীক্ষা চলাকালীন ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আমি নিজেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছি। দেশটা নরক হয়ে যাচ্ছে আমি এটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলিনি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে এটা বলেছি। সে হয়ত বুঝতে ভুল করেছে।
তিনি বলেন, আমরা চাই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার স্থায়ী সমাধান হোক। এটা নিয়ে ডিন মহোদয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিষয়টির স্থায়ী সমাধান করা হবে, যাতে কাউকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।
কেএইচ/এসএসএইচ