মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গত বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তবে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও জনসমাগম বন্ধ নেই। বন্ধ ক্যাম্পাসে মাদক সেবন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, নবজাতকের লাশ উদ্ধারসহ নানা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের দাবি, ঢাবি প্রশাসনের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার ফলে থামছে না ক্যাম্পাসে এসব ঘটনা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনাকালে বন্ধ ঢাবি ক্যাম্পাসের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সায়েন্স এনেক্স ভবন ও কার্জন হল মাদক সেবনের বড় আস্তানা। চারুকলা থেকে রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত ফুটপাতে (উদ্যানের পাশে) ফেনসিডিল ও গাঁজা সেবন চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বহিরাগতরাও যোগসাজশে এসব অপরাধমূলক কাজ করছেন। 

সোমবার (৩১ মে) দুজন বহিরাগত এবং ৫ মার্চ টিএসসি থেকে গাঁজা সেবনের দায়ে বহিরাগতসহ তিনজনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম। এছাড়া গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে গাঁজা সেবনের সময় ৩ জনকে টিএসসি থেকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া একই বছরের ১ আগস্ট মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় তাদের হামলায় আহত হন প্রক্টরিয়াল টিমের চার সদস্য। এই ঘটনার বাইরেও বন্ধ ক্যাম্পাসে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। 

সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুতে ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডির যোগসূত্রের কথা জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা জানিয়েছে, মৃত্যুর আগে বন্ধুদের সঙ্গে মাদক সেবন করেছিলেন হাফিজ। এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর ক্যাম্পাসে মাদক নির্মূলের জোরালো দাবি উঠেছে। 

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল রাশেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মদ-গাঁজা খাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। যারা এসব খান তারা এটাকে ফ্যাশন মনে করেন। মাদকসেবীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সন্দেহজনক শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্টের মধ্যমে চিহ্নিত করে পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখে তাদের জীবনকে স্বাভাবিক গতিধারায় নিয়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যাম্পাস মাদক সেবন ও বেচাকেনার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। আর চরম বাস্তবতা হচ্ছে, মাদক সেবন ও কেনাবেচার এই অপকর্মে ছাত্রনেতারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে মাদকমুক্ত করতে সকলের আওয়াজ তোলা জরুরি।

ক্যাম্পাসে নবজাতক ফেলে যায় কারা?

ঢাবি ক্যাম্পাসে নবজাতকের লাশ উদ্ধার একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত চার বছরে অন্তত দশটি নব জাতক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালীন বন্ধ ক্যাম্পাসে তিনটি নবজাতক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছন থেকে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর জগন্নাথ হলের বিপরীত পাশে অবস্থিত বুয়েট স্কুলের গেটের ডান পাশের ড্রেন থেকে গামছা মোড়ানো একটি কন্যা নবজাতকের লাশ উদ্ধার হয়। এই ঘটনার কয়েক দিনের ব্যবধানে ৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের পেছন থেকে আরও একটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কারা, কী উদ্দেশ্যে নবজাতক ফেলে যায়? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেটা বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি ঘটনাতেও তারা তদন্ত করে বের করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নবজাতক ফেলার নিরাপদস্থল হিসেবে ব্যবহার করে কারা। 

ক্যাম্পাসে অপকর্মে বহিরাগতদের অংশগ্রহণ 

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টি করা, বিভিন্ন অপরাধে অংশ নেওয়াদের বড় একটি অংশ বহিরাগত। ক্যাম্পাসে মাদক সেবনের দায়ে বেশ কয়েকজন বহিরাগতকে পুলিশে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া ক্যাম্পাসে সংগঠিত বেশ কয়েকটি হামলায় অংশ নেয় বহিরাগতরা। সর্বশেষ হাফিজুর রহমানের মৃত্যুতেও সন্দেহভাজনদের মধ্যে একজন বহিরাগত। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যোগসাজশে এসব অপকর্ম করার সাহস পাচ্ছে বহিরাগতরা। তাছাড়া বহিরাগতদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতেও ব্যর্থ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অন্ধ সিসিটিভি 

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংগঠিত নানারকম অপকর্মের বড় দায় আছে অকার্যকর সিসিটিভির। ডাকসুতে হামলা, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, মাদক সেবনের আড্ডা, মধুর ক্যান্টিনে ককটেল বিস্ফোরণ কোনোটিই সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায়ও এটি স্পষ্ট। ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভি অন্ধ থাকায় তদন্তে সঠিক তথ্য বের করতে কর্তৃপক্ষ অসমর্থ হচ্ছে। অথচ বুয়েটে আলোচিত আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের জন্য। 

ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা 

হাফিজুরের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের এমন অবস্থার জন্য দায়ী করছেন প্রশাসনকে। শিক্ষার্থীরা ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া, কিন্তু সেটাতে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।

এ প্রসঙ্গে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাবি নিরাপত্তা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস সিজার তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন নানাভাবে অনিরাপদ। আমরা যদি শুধুমাত্র নিরাপত্তার বাহ্যিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেই তাহলেও দেখব ক্যাম্পাসে অবাধে চলে মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, চুরি-ছিনতাই, সংঘাত এবং বহিরাগত যানবাহনের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত চলাচলে স্বাভাবিক শিক্ষা ও আবাসিক জীবন চরমভাবে ব্যাহত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা যে হারিয়েছে তা তো প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দেখলেই পরিষ্কার। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তুলনা করে র‍্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকাকে সার্থকতা মনে করে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সতর্ক আছে এবং এখন থেকে আরও বেশি সতর্ক থাকবে; যাতে এমন ঘটনাগুলো আর না ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীরা অনিরাপদ ভাবছে কি না জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, বিশাল ক্যাম্পাস, উন্মুক্ত ক্যাম্পাস। এখানে মানুষের অবাধ যাতায়াত আছে। মানুষের ভেতরেই অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে। এতবড় ক্যাম্পাসে অনেকে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আমরা সে সুযোগ সীমিত করে ফেলব। কোনোভাবেই আমরা সুযোগ দিতে চাই না। আর যারা এর অপব্যবহার করছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সবার প্রতি অনুরোধ- দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেকোনো ধরনের অপরাধ ও বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকুন।

ক্যাম্পাসে মাদক সেবনের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় মাদকাসক্তরা এটিকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম তাদের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ অভিযান পরিচালনা করছে। আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম সম্প্রতি দুজন মাদকাসক্তকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কাউকে যদি এসব কাজে জড়িত পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ও অ্যাকাডেমিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বহিরাগতদের বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ক্যাম্পাসে প্রবেশের ক্ষেত্রে কারও আইডি কার্ড চেক করা হয় না। আমরা সবাই যদি একমত হই তাহলে আস্তে আস্তে ক্যাম্পাসে প্রবেশাধিকার সীমিত করা যাবে। উন্মুক্ত ক্যাম্পাসকে কতটুকু উন্মুক্ত রাখা যায় সে ব্যাপারে আমাদের ঐকমত হতে হবে।

অকার্যকর সিসিটিভি ক্যামেরার বিষয়ে প্রক্টর বলেন, ক্যাম্পাস সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আছে। কিন্তু অনেকেই লাইন কেটে দেয়। আমি  জানতে পারলাম বেশিরভাগ সিসিটিভির লাইন কাটা। কয়েকবার লাগানোর পরও লাইন কেটে দেওয়া হয়। যারা এসব কাজে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি। লাইট দিলে লাইট ভেঙে ফেলি, অন্ধকার রাখার জন্য। সিসিটিভি ক্যামেরার তার কেটে ফেলি। 

প্রক্টর বলেন, আগামীতে যাতে এসব ঘটনা না ঘটে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে থাকবে। আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখি, এখন থেকে ক্যাম্পাসে চুরি, দা, কাঁচি ইত্যাদি ধারালো জিনিস রাখা যাবে না। এসব নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা যাবে না। ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্ধার করা হয়েছে। এই কাজে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদকদ্রব্য গ্রহণ করা তো একটি সামাজিক সমস্যা, এটা নিরাপত্তার সমস্যা না। আমরা যারা এখানে বসবাস করি এবং যারা এখানে আসে উভয়ের মধ্যে দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। তাহলে এসব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর সিসিটিভি ক্যামেরার বিষয়টি মূলত সেন্ট্রালি কন্ট্রোল না থাকায় এমন অবস্থা। কন্ট্রোলে থাকলে কোনটা সচল, কোনটা অচল সেটা শনাক্ত করা যেত। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেত। সেন্ট্রাল কন্ট্রোলিং সিস্টেমটা হলে এই সমাধান পাওয়া যাবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বেশকিছু সিদ্ধান্ত আছে। কিন্তু কার্যকর নেই। আমাদের প্রশাসনিক দুর্বলতাও আছে বলে আমি মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য আমাদের আরও একটু শক্ত হওয়া দরকার।

এইচআর/এইচকে