কোটা বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'রাজাকার' মন্তব্যের জেরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং সারাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা।

মিছিলটি মুরাদ চত্বর, পরিবহন চত্বর, চৌরঙ্গী, ছাত্রী হল সড়ক, অমর একুশে ও জোবায়ের সরণি হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে পৌঁছায়। এ সময় বটতলা দিক থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা একটি পাল্টা মিছিল নিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা চালায়।

একাধিক ভিডিও ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আগে থেকেই বটতলা এলাকায় অবস্থান করছিলেন। আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে দিয়ে বটতলার দিকে অগ্রসর হলে তারা হামলার শিকার হন।  শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনকে সামনে থেকে হামলার নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় ভিডিওতে।

এ সময় প্রায় ঘণ্টাব্যাপী দুই পক্ষের মাঝে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে আন্দোলনকারীদের ধাওয়ার মুখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ঢুকে ছাদ থেকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। আন্দোলনকারীরা কিছুক্ষণ হলের সামনে অবস্থান করে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করেন এবং পরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।

রাত গভীর হতে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে খবর আসে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ট্রাকে করে বহিরাগতদের এনে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নেন।

উপাচার্যের বাসভবনের সামনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ঠিক ১২টার দিকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গেটের সামনে থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। রাত ১২টা ৩ মিনিটের ফুটেজে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে বাসভবনের ভেতরে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করতে দেখা যায়।

রাত ১২টা ৭ মিনিটে পুলিশের একটি দল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আসে, তবে তাদের নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায়। এরপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা খেলার মাঠের দিকে সরে যান। রাত ১২টা ৪৬ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা বিষয়ক সম্পাদক রতন বিশ্বাস, তৎকালীন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফীর সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলছেন।

রাত ১টা ৩৭ মিনিটে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আবার উপাচার্যের বাসভবনের দিকে এগিয়ে আসেন। ১টা ৩৮ মিনিটে তারা গেট ভেঙে বাসভবনের ভেতরে ঢুকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান।

এ সময় সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মালিহা নামলা ফেসবুকে লাইভে এসে প্রাণ বাঁচাতে আকুতি জানান। এরপরই বিভিন্ন হল থেকে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাসভবনের দিকে ছুটে আসেন। উপাচার্যের বাসভবন থেকে অবরুদ্ধ শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করেন। 

রাত ১টা ৫৭ মিনিটের ফুটেজে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের গেটের সামনে এসেছে। পুলিশ তাদের গেট না ছাড়তে চাইলে পুলিশকে সরিয়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গেলে ক্যাম্পাসের আমবাগান গেট দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পালিয়ে যেতে দেখা যায়। তারা পালিয়ে গেলেও পুলিশ তখন শিক্ষার্থীদের ওপর অ্যাকশনে যায়। 

রাত ২টা ১৯ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে ছুড়তে বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করছে।

একই সময়ে বাসভবনের বাইরে থাকা সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় পুলিশ। এতে আহত হন বণিক বার্তার মেহেদী মামুন, দৈনিক বাংলার আব্দুর রহমান খান সার্জিল, বাংলাদেশ টুডে’র জোবায়ের আহমেদ এবং দৈনিক জনকণ্ঠের ওয়াজহাতুল ইসলাম।

পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে প্রবেশ করলে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী গুলিবিদ্ধ হন। তিনি ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান, তার শরীরে ৭০টিরও বেশি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীও গুলিবিদ্ধ হন।

অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, আমি পুলিশকে হাত উঠিয়ে বলি, আমি শিক্ষক, আপনারা ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো বন্ধ করুন। তার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি দেখলাম আমার চোখ আলোর ফুলকি মতো জ্বলে উঠলো। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। 

সেদিন রাতেই ধাওয়া খেয়ে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ছাড়ে। তবে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মওলানা ভাসানী হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার রুমসহ কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর করেন। এভাবেই সবার আগে প্রথম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

গত ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৫ জুলাইকে ‘কালরাত্রি’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই রাতের স্মরণে কর্মসূচি হিসেবে রয়েছে -উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জমায়েত, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, স্মৃতিচারণ এবং মোমবাতি প্রজ্বলন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, জুলাইয়ের হামলার তদন্ত ও বিচারকার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করছি, দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

মেহেরব হোসেন/এনটি