করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গতবছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৫ মাস। দীর্ঘ এ সময়ে আবাসিক হলে অবস্থান করেননি শিক্ষার্থীরা, নেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সেবাও। তবু তাদের গুনতে হচ্ছে সব ধরনের ফি। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিষয়টিকে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা বলছেন শিক্ষার্থীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভাগ/ইনস্টিটিউটগুলো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। এসময় শিক্ষার্থীদের হল ইউনিয়ন ফি, বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়ন ফি, বিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলা ফি, হল খেলাধুলা ফি, ছাত্র/ছাত্রী কল্যাণ ফি, হলের সিট ভাড়া, বাসনাদি ফি, হেলথ কার্ড ফি, গ্রন্থাগার উন্নয়ন ফি, পরিবহন ফি দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে বিভাগভেদে ল্যাব ফিসহ অন্যান্য ফি। এসব ফি পরিশোধ না করলে দেওয়া হচ্ছে না হল ক্লিয়ারেন্স, শুধু তাই নয় আটকে দেওয়া হচ্ছে ভর্তি, পরীক্ষা ও সনদসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র।

হিসাব পরিচালকের দফতরের তথ্যমতে, হল সিট ভাড়া ৬০০ টাকা, বাসনাদি ফি ৫০ টাকা, হল ইউনিয়ন ফি ৬০ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়ন ফি ৬০ টাকা, হল খেলাধুলা ফি ৫০ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলা ফি ৫০ টাকা, ছাত্র কল্যাণ ফি ২৫ টাকা, হেলথ কার্ড ফি ৫০ টাকা, গ্রন্থাগার উন্নয়ন ফি ১২৫ টাকা, পরিবহন ফি ১০৮০ টাকা এবং হল আইডি কার্ড রিনিউ ফি ১৭০০ টাকা। জনপ্রতি মোট ৩৮৫০ টাকা ফি গুনতে হচ্ছে বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের। হল ভিন্ন হলেও  আবাসিক-অনাবাসিকভেদে টাকার পরিমাণ অনেকটা কাছাকাছি।

সব ফি মওকুফের দাবি শিক্ষার্থীদের

শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলে না থেকে হল ফি, পরিবহন ব্যবহার না করে পরিবহন ফিসহ অন্যান্য ফি আদায় তাদের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। যেখানে করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের পরিবার আর্থিক সংকটে রয়েছে, সেখানে প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের কারণে আরও বিপাকে পড়তে হবে তাদের। তাই সব ধরনের ফি মওকুফের দাবি জানান তারা।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নমূলক। দীর্ঘদিন বাড়িতে অবস্থান করায় আমরা অনেকেই এখন পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। সেখানে প্রশাসন কোন জ্ঞানে পরিবহন ফি, হল ফি, বাসন বাবদ ফি ইত্যাদি ফি আদায় করতে চায়। প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত মোটেও ছাত্রবান্ধব নয়।

ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন হৃদয় বলেন, এরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে অহেতুক ফি আদায় করা নিছক কৌতুকের সঞ্চার করে। যেখানে নিজেরা পরিবারে দিন দিন বোঝা হয়ে যাচ্ছি, সেখানে শিক্ষার্থীদের কাছে আবার ফি দাবি করা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।

ফি আদায়ের প্রভাব ভর্তিতে পড়বে উল্লেখ করে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. স্বাধীন বলেন, করোনাকালে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আমরা উপার্জন শূন্য হয়ে গেছি। এ অবস্থায় আমাদের ওপর ফি চাপিয়ে দেওয়া হলে ভর্তি হওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়বে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ মোস্তফা বলেন, করোনা মহামারিতে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের পারিবারিক আয় কমে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী খুব অর্থ কষ্টে দিনযাপন করছে। এর মধ্যে ১৫ মাস ধরে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও ভর্তি ও পরীক্ষা বাবদ যে ফি ধরা হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায়। এই অমানবিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান এবং ফি মওকুফ দাবি করছি।

করোনাকালে ফি আদায়ে নিন্দা ছাত্রনেতাদের

ক্যাম্পাস বন্ধ থাকার পরও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা ফি আদায়ের নিন্দা জানিয়েছেন ছাত্রনেতারা। সেই সঙ্গে তারা এসব ফি মওকুফের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরও একটি স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত। অবিলম্বে সব ফি মওকুফের দাবি জানান তারা।

জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গা থেকে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। করোনাকালে অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক পরিবারের আয়-রোজগার কমে গেছে। তারচেয়ে বড় কথা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল, শিক্ষার্থীরা এসবের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। গুটিকয়েক অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ধান্ধা হাসিলের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

ডাকসুর সাবেক এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, শিক্ষার্থীরা আর্থিক সংকটের মুখে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়েরও শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করার প্রয়োজন হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বিশেষ করে হলের আবাসিক ফি এবং পরিবহন ফি গ্রহণ করা উচিত নয়। আমরা এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা আবারও কথা বলব।

সব বেতন-ফি মওকুফ করার দাবি জানিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, করোনার এই সময়ে কোনো সেবাগ্রহণ না করা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের থেকে ফি নেওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। করোনাকালে অধিকাংশ শিক্ষার্থী আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের ফি দিতে চাপ দিচ্ছে। এটি তাদের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এই অথর্ব প্রশাসনকে আমরা ধিক্কার এবং করোনাকালীন সব বেতন-ফি মওকুফ করার দাবি জানাই।

অযৌক্তিক বলছেন শিক্ষকরা

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা এমনিতেই মানসিকভাবে-আর্থিকভাবে বিপাকে আছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিউশনি করে জীবন নির্বাহ করত কিন্তু সে টিউশনিও এখন নেই। আর যে কারণে টাকাটা নেওয়া হচ্ছে, সে কারণটা অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের পেছনে খরচ করতে হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটা একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই মওকুফ করে দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, এমনিতেই করোনায় মানুষ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে গেছে। শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারে দুরবস্থা  চলছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের কথা বিবেচনা করে ফিগুলো মওকুফ করে দেওয়া যায় কিংবা যাদের ফি দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের দরখাস্ত আহ্বান করে ফি মওকুফ করা যায়। এই ফি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা অস্বস্তি। এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের সমর্থন দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও সব ব্যবস্থাপনাগুলো ক্রিয়াশীল রাখতে হয়। পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, লাইব্রেরিসহ সব সেবা ক্রিয়াশীল রাখতে হয়। এগুলোর সেবা কার্যক্রম নেই কিন্তু ব্যবস্থাপনাগুলো আছে। শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতে পারছে না সত্যি কিন্তু সবগুলোর পেছনে আমাদের খরচ হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা রাখতে হচ্ছে। তাই ফিগুলো নেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ফি মওকুফের দাবির বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আমাকে দেখতে হবে আগে ওই সব খাতে কেমন টাকা আসে, কয় টাকা আসে এবং খরচ কেমন। শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টিও আমরা বিবেচনায় রাখব। সবকিছু বিবেচনায় রেখে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে চাই।

প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা সত্য যে আমাদের শিক্ষার্থীরা হলে নেই, সেবাগ্রহণ করছে না। বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার। আমি বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর অবহিত করব। শিক্ষার্থীরাও যেন তাদের বিষয়গুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন করে এবং কর্তৃপক্ষ অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে আমি মনে করি।

এইচআর/এসএসএইচ