দুপুর ১টা, তিন শতাধিক মানুষ অপেক্ষায় আছেন। কবে তানভীর হাসান সৈকত আসবেন, তারা ক্ষুধা নিবারণ করবেন। অতঃপর ২টায় তিনি আসলেন এবং সবার হাতে খাবার তুলে দিলেন। কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালে এমন চিত্র দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসিতে।

খাবারের জন্য অপেক্ষায় থাকা দিনমজুর আবুল কাসেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুনেছি টিএসসিতে সৈকত ভাই নামে একজন খাবার দেয়, তাই সবার সঙ্গে এখানে অপেক্ষা করছি। কোনো কাজ নেই, বয়সও অনেক। কেউ খেতে দিলে খেতে পারি, না হয় না খেয়ে থাকতে হয়। টিএসসিতে আসি খাই, বঙ্গবন্ধুর জন্য দোয়া করি। যিনি আমাদের খাওয়াচ্ছে তার জন্য দোয়া করি, যেন আল্লাহ উনাকে ভালো রাখে।

খাবারের অপেক্ষায় আছেন ইসহাক সরকারও। তিনি বলেন, লকডাউনে কোনো কাজ নেই। সৈকত ভাই না খাওয়ালে না খেয়ে থাকতে হতো। কয়েকদিন ধরে দিনে ও রাতে এখানে খাচ্ছি। যারা খাওয়াচ্ছে তাদের জন্য দোয়া করি।

গত ৩ জুলাই থেকে বিধিনিষেধের শেষ দিন বুধবার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত উদ্বাস্তু, উপার্জনহীন, ফুটপাথে ঘুমানো, প্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন দুস্থ মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। খাবার বিতরণে সৈকতকে সাহায্য করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নাহিদ, মার্কেটিংয়ের মাঈদুল, স্বাস্থ্য অর্থনীতির মেহেদী ও সঙ্গীত বিভাগের সুজন প্রমুখ। প্রথম দিকে একবেলা খাবার দিলেও পরবর্তীতে দুই বেলা তারা ছিন্নমূল মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। নিজেরা রান্না করে প্রতি বেলায় খাওয়াচ্ছেন প্রায় ৩০০-৫০০ মানুষকে।

শুধু এবারই প্রথম নয়, করোনার শুরু থেকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে থাকতে দেখা গেছে তানভীর হাসান সৈকতকে। গত বছর করোনা মহামারির শুরুতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছিন্নমূল মানুষকে টানা ১২১ দিন দুই বেলা খাবার দিয়েছেন তানভীর হাসান সৈকত ও তার বন্ধুরা। শুধু তাই নয়, ওই সময়ে বন্যা পরিস্থিতিতেও তিনি উত্তরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, দিয়েছিলেন খাদ্য সহায়তা।

 

চলতি বছর এপ্রিলে আবারও লকডাউন ঘোষণা করা হলে খাবার বিতরণের পাশাপাশি রাজধানীর মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে হাসপাতালে যাতায়াতে বিনামূল্যে পরিবহন সেবা এবং উপার্জনহীন পরিবারের শিশুদের জন্য বিনামূল্যে গুঁড়া দুধ পৌঁছে দিয়েছে সৈকতের নেতৃত্বে একটি দল। এসবের স্বীকৃতিস্বরূপ গত বছর ১৯ আগস্ট বিশ্ব জাতিসংঘ থেকে পেয়েছেন ‘রিয়েল লাইফ হিরো' খেতাব। এছাড়াও পেয়েছেন মানবিক ছাত্রনেতার তকমা।

এসব কার্যক্রমের বিষয়ে তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ঢাকা শহরে অসংখ্য মানুষ রয়েছে তাদের জীবনই হলো দুই বেলা খাবারের সংগ্রাম। লকডাউনে খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আমার এখানে যারা খেতে আসে তাদের ঘরবাড়ি নেই, ভাসমান, ছিন্নমূল মানুষ। এ সময়ে তাদের কেউ খাবার না দিলে, তারা খেতে পারবে না। লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে এ মানুষগুলো। মানুষগুলোর জন্য কিছু করার তাগিদে আমরা চেষ্টা করছি তাদের মুখে হাসি ফুটাতে।

মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর যে হাসি সেটা কোটি টাকার চেয়েও মূল্যবান উল্লেখ করে ছাত্রলীগের এই উপ-সমাজসেবা সম্পাদক বলেন, করোনার শুরু থেকে যখন আমরা মানুষের কাছে খাবার দিতে যাই তখন অসংখ্য মানুষকে পেয়েছি যারা শুধু 'খাবার' এই শব্দটা শোনার পর ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেছে। মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদা খাদ্য কিন্তু শহরের অসংখ্য মানুষ আছে যাদের এই খাবারের নিশ্চয়তা নেই। আমরা দেখেছি খাবারের জন্য মানুষের হাহাকার। একজন অনাহারী মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর যে হাসি সেটা কোটি টাকার চেয়েও মূল্যবান।

এই কার্যক্রম কতদিন চলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ হলেও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আমাকে সহযোগিতা করছে। যার কারণে আমি এই কাজটি করতে পারছি। আমার ইচ্ছে যতদিন লকডাউন/বিধিনিষেধ থাকবে, এই মানুষগুলো বিপদগ্রস্ত থাকবে ততদিন খাদ্য সহায়তা দিয়ে পাশে থাকব।

এইচআর/এসকেডি