আশরাফুল ইসলাম সুমনের ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক বাবার ঘরে জন্ম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। সম্প্রতি পোর্ট সিটি ইন্ট্যারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাচারাল সাইন্স বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।

নিজ গ্রামে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে পোহাইল বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন। কৃষক বাবা আবুল হোসেন এবং গৃহিণী জোৎস্না বেগমের পরিবারে তিন ছেলে আর এক মেয়ে। সুমন পরিবারের বড় ছেলে। মাধ্যমিকের পর থেকেই শুরু করেন টিউশনি। নিজের খরচ যুগিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করতে আরম্ভ করেন ব্যাচ ভিত্তিক পড়ানো।

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই ঝোঁক উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। অজপাড়াগাঁয়ে থাকায় এ ব্যাপারে কার সহযোগিতা নেবেন সেই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ঢাকায় থাকা এক মামার কাছে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। সুযোগ পেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ঝোঁক আর গণিতের ওপর ভালোলাগা থেকেই পরিসংখ্যান বিভাগকেই বেছে নিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পথচলা। পরিবার থেকে খরচ দেয়া সম্ভব ছিল না। সেজন্য আবারো শুরু করলেন টিউশন। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ সব মিলিয়ে প্রথম তিনমাস টিউশন ছাড়াই চলতে হয়েছে। এরপর দুইটা টিউশন পেলেন। যা দিয়ে প্রথম বর্ষ চলে গেলেও পরিবারকে সহায়তা করা সম্ভব হতো না। এজন্য আরো দুটো টিউশন জোগাড় করলেন। টিউশন, পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদচারণা ছিল সব ক্ষেত্রেই, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন সক্রিয়ভাবে। এরমধ্যে সামাজিক সংগঠন বিন্দু, বিতর্ক সংগঠন সিইউডিএস, সাংস্কৃতিক সংগঠন অঙ্গনসহ অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।

শুনতেন টিউশন করলে রেজাল্ট ঠিক আসে না, কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন সুমন। এগিয়েছিলেন একান্ত নিজের মতো করে। প্রথমবর্ষে যখন মেধাতালিকায় নিজেকে প্রথম তিনজনে দেখেছিলেন সেদিন থেকেই জীবনের মোড় নিয়েছিল ভিন্নভাবে। তবে অনার্স ফাইনালে সিজিপিএ ৩.৪৮ আসায় একটু হতাশা হয়েছিলেন। তবে হাল ছাড়েননি। ফলস্বরূপ মাস্টার্স এ সিজিপিএ ৩.৭৫ আসে (থিসিসসহ)। বিভাগের সেরা চারজনের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেয়ে সব কষ্টের গল্প ভুলে যান। 

প্রাইভেট পড়ানো, নিজের পড়ালেখা, ক্লাসসহ অন্যান্য সব কাজ কীভাবে ভালো রেজাল্ট সম্ভব হয়েছে? প্রশ্নের উত্তরে স্বভাবসুলভ হাসি টেনে বলতে লাগলেন সুমন, নিয়মিত ক্লাস করতাম, এরপর ক্লাস শেষে টানা ৬/৭ ঘণ্টা টিউশন। রুমে এসে ১২টার পর বই নিয়ে বসে গভীর রাত পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকতো। বন্ধের দিনগুলোতেও কাজে লাগাতাম।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আশরাফুল ইসলাম সুমনের অনুপ্রেরণায় সবার আগে বাবা-মা। পরিবারে উপার্জনের একমাত্র ব্যক্তি বাবাই ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। নিজের দুই খণ্ড জমির বাইরে অন্যদের জমি চাষ করে সংসার চালানো বাবা সবসময় সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। 

সুমন বললেন, বাবা-মা ছিলেন সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এতদূর আসা কল্পনার বাইরে ছিল। পরিসংখ্যান বিভাগের প্রিয় রোকোনুজ্জামান স্যারের অনুপ্রেরণা ছিলো বর্ণনার বাইরে। সবকিছুতেই শতভাগ দিয়েছি বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি শিক্ষক এবং বন্ধুদের। সবার প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞতা থাকবে। 

প্রতিটা মানুষের জীবনে আছে সংগ্রামের সম্মীলন। নিজেকে বারংবার ছাড়িয়ে যাবার প্রত্যাশায় যে সংগ্রাম চলে অবিরাম। প্রতিনিয়তই অতিক্রম করতে হয় নানান জরাজীর্ণতা। ভালো ফলাফল সব কষ্ট মুছে দিয়ে যায় নিমিষেই। আশরাফুল ইসলাম সুমনের ক্ষেত্রেও ঘটেনি ব্যতিক্রম। 

তিনি বলেন, মাস্টার্স গবেষণায় স্বীকৃতি স্বরুপ বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের স্কলারশিপে মনোনীত হই। মাস্টার্স শেষ করে স্বাভাবিক প্রস্তুতি নেব তখনই করোনা মহামারির আঘাত। ভয় এবং শঙ্কা কাজ করছিল জীবন নিয়ে। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ এলো। পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক হিসেবে ২৮ আগস্ট যখন নিয়োগপত্রটা হাতে পাই সেদিনের মতো আনন্দ জীবনে আর দ্বিতীয়বার আসে নাই। একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নপূরণের সাথী হতে পেরে অনেক বেশি 

এমএএস