বিদ্যাবাতি পাঠাগার

বাড়িতে থাকা একটা এনজিওর কিছু বই দেখে মনে পাঠাগার গড়ার স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন। স্বপ্ন-বীজের অঙ্কুরোদগম হয় ষাঁড় বিক্রির টাকায়। ষাঁড় বিক্রি করে প্রতিষ্ঠা করেছেন পাঠাগার। বাড়িতে একটাই থাকার ঘর। আরও ঘর দরকার। তবুও পাঠাগারের ঘর তৈরিতে নেমে গেলেন তিনি।

স্বপ্ন বাস্তবায়নে বছরের পর বছর টাকা জমিয়েছেন নাজমুল। অধুনা নাগরিক সংস্কৃতিতে বৈশাখ মানে পাঞ্জাবি আর ইলিশ-পান্তা ভাত। ঘটা করে হয় শপিংও। পাঞ্জাবির বদলে নাজমুল করেন 'বই শপিং'। পাঠাগারের জন্য বই সংগ্রহের তিলতিল চেষ্টার নাম দিয়েছেন 'বই শপিং'।

শ্রমিক বাবার সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয় পড়া যে গ্রামের মানুষ বিলাসিতা ভাবেন, তাদের সন্তানদের আলোকিত করার জন্য এ পাঠাগার— নাম ‘বিদ্যাবাতি’।

নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি গ্রামের সন্তান নাজমুল মৃধা। বাবা মো. শাহজাহান মিয়া সাজুর একমাত্র ছেলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে মাস্টার্সে পড়ছেন। গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিদ্যার বাতি জ্বালাতে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেছে ‘বিদ্যাবাতি’ পাঠাগার। বিদ্যাবাতির গল্প করেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।

বিদ্যাবাতি পাঠাগারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বই হাতে অতিথি ও পাঠক

‘পারিবারিক সমস্যা বা আর্থিক টানাপোড়েনে অনেক স্বপ্নই অপূরণীয় থেকে গেছে। এসব এখন স্বাভাবিক। বড় হয়েছি, আবার স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এখনও বাড়ির বাইরে থাকি; বাকি জীবন তো আরও বাইরে থাকতে হবে। তাহলে কবে প্রতিষ্ঠা করব নিজের ইচ্ছা। আর পরে সেই ইচ্ছাগুলো এমন প্রাণবন্ত থাকবে কি-না কে জানে!’
 
‘দেরি করলাম না। বিদ্যাবাতি পাঠাগার এখন দৃশ্যমান। ৪ বছর ধরে টাকা জমিয়েছি। জমতে জমতে পঞ্চাশ হাজার হয়েই গেল। কীভাবে জমিয়েছি না বলি, ওটা ভালোবাসার গল্প, তিক্ততায় ভরা।’ এভাবেই বিদ্যাবাতি পাঠাগারের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার গল্প শুরু করলেন নাজমুল মৃধা।

বিদ্যাবাতির শুরু

আমি তখন এইচএসসিতে পড়ি। এলাকায় ‘এফআই বিডিবি’ নামে একটা সংস্থা আসে যারা  গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক স্কুল চালু করে। যেখানে তাদের একটা পাঠাগারও ছিল। সেটি ছিল আমাদের ঘরে। আম্মা ক্লাস সেভেন পাস। ওরা দিতে চায়নি। অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ পর্যন্ত পেলেন। বাড়ি এসে দেখতাম অনেক বই। নিজেও পড়তাম। এলাকার ছেলেমেয়েরা পড়ত বই নিয়ে। সেই থেকেই বইয়ের সঙ্গে পরিচয়।

বিদ্যাবাতির বুকশেলফে বই

২ বছর পর সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়। আর পাঠক খুঁজে পায় না সেসব বই। পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অযত্নে পরে থাকতে দেখে খুব মায়া হতো। বাড়ি গেলে বইগুলো পরিষ্কার করতাম। হাতে তখনও টাকা নেই। পরিবারের অভাব অনটনে বইগুলো নিয়ে নতুন করে কিছু করার সাহস পাইনি। বাবা বিদেশে শ্রমিকের কাজ করে। ঠিকঠাক টাকা পাঠাতে পারতেন না।

দানা বাঁধতে শুরু করে স্বপ্ন

এরই মধ্যে এইচএসসি পাস করি। মাত্র রাবিতে ভর্তি হয়েছি। প্রথমবর্ষের শেষের দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সদস্য হই। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন বই দিত, পড়তাম। সেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হতো। পাঠচক্র থেকে অনেক কিছু শিখলাম। বই তো মানুষকে সুচিন্তার অধিকারী করে তোলে। আমি তো অবাক। আমার বাড়িতেই তো বই আছে। তখন থেকে স্বপ্ন আরও বড় করে দানা বাঁধতে শুরু করে বইগুলোকে আবারও পাঠাগারে রূপ দেওয়ার ।

কাপড়ের টাকায় ‘বই শপিং’

প্রথমবর্ষ থেকেই বিভিন্ন বই কেনার অভ্যাস ছিল। প্রতি পহেলা বৈশাখে আমি কাপড়ের বদলে 'বই শপিং' করতাম। বৈশাখের জন্য তাই ধৈর্য্য ধরে টাকাও জমাতাম। যখনই বই পছন্দ হতো কিনে ফেলতাম। একসময় এ বই-ই তো পুঁজি করে পাঠাগার করব— এ স্বপ্নে বই সংগ্রহ করতাম। এভাবে আমার শ’খানেক বই হয়ে যায়।

ষাঁড়ের টাকায় পাঠাগার

এইসব ভাবতে ভাবতে ৪ বছর পার হয়েছে। টাকা নেই, ঘর নেই। কোথায় হবে পাঠাগার। জমাতে শুরু করলাম টাকা। নিজের জমানো আর স্ত্রীর সহায়তায় ২৩ হাজার টাকা দিয়ে একটা ষাঁড় কেনা হলো। ৩ বছর সেই ষাঁড়ের দেখাশোনা করলেন মা নার্গিস আক্তার। পরে ঈদুল আজহায় সেটি বিক্রি করা হয় ৪৭ হাজার টাকায়। সঙ্গে আরও কিছু টাকা যোগাড় করে বানানো হলো পাঠাগারের ঘর।

এ পাঠাগার গড়ার স্বপ্ন আর প্রেক্ষাপটের গল্প যাদের জানা তাদের কাছে যেমন উৎসাহ পেয়েছেন, তেমনি পরিবারের সদস্যদের মনোকষ্টের কারণ হয় এ পাঠাগার। তবুও থমকে যাননি। একার সাহসে অবাক হয়েছেন গ্রামের অনেকেই। ৫০ হাজার টাকা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের জন্য বিশেষ কিছু। এতোগুলো টাকায় ঘর করেছেন পাঠাগারের জন্য, গায়েই লাগেনি। বরং ঈদ ঈদ লেগেছে, যে অন্তত ইচ্ছেটা তো দাঁড়াল।

 বিদ্যাবাতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল মৃধা

নাজমুল বলছেন, ‌‘রাজশাহী থেকে বাড়ি চলে যাই কাজ শুরু করতে। এদিকে মাত্র ১৫ দিন আগেই পরিবারে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। সবাই মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম, তবে কি পাঠাগারটি করতে পারব না? পরে ভাবলাম যা হবার হবে তবুও পাঠাগারটি দাঁড় করাবই।’

‘আমাদের একটাই থাকার ঘর। আরও ঘর দরকার। তবুও পাঠাগারের ঘর বাঁধতে নেমে গেলাম। এজন্য বাড়ির অনেকেই মন খারাপ করেছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, এতো টাকা কই পেল? কেনই বা এই ঘর করছে? আজাইরা খরচ। আমার বাবা-মায়েরও হয়তো একটু খারাপ লাগবে এসব কথা শুনে। তবে আমি তাদের বোঝাতে পারিনি, পারবও না; যদি এর সুফল এলাকায় না দেখাতে পারি। কিন্তু আমি চেয়েছি মানুষ আলোকিত হোক।’
বিদ্যাবাতি পূর্ণাঙ্গ পাঠাগার হিসেবে সাজাতে সহায়তা কামনা নাজমুলের

তবে পুরো কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন আর সহযোগিতা পেয়েছেন স্ত্রীর কাছ থেকে। ‘আমার স্ত্রীর আর্থিক ও মানসিক সাহায্য না থাকলে এটি সম্ভব হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই বিয়ে করেছি। আমার ওপর যেন চাপ না পরে সেজন্য বাপের বাড়ি থাকে এখনও। বাবা ওকে খরচের টাকা দিলে সেগুলোর একটা অংশ আমাকে দিত যেন পাঠাগারটির জন্য সেভ করতে পারি।’ বলছিলেন নাজমুল।

আক্ষেপে-প্রত্যাশায় স্বপ্ন

আমাদের গ্রামটি অনেকটা প্রত্যন্ত, ফলে শিক্ষার আলো খুব কমই ছড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো না থাকায় পড়ালেখাটাকে অভিশাপ মনে করত তারা। আমাকে অনেকেই তাচ্ছিল্য করত। কষ্ট পেতাম। কিন্তু মনে মনে ভাবতাম একটা পাঠাগার হয়ত পারবে গ্রামের পরিবেশ বদলে দিতে, মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিতে। পড়াশোনা নিয়ে আমাকে কাছের মানুষও তিরস্কার করে। তারা শিক্ষার আলো পায়নি। আমি চাই তাদের সন্তানরা বই পড়ে আলোকিত হোক। যেন বাবা-মায়ের মতো অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে না থাকে।

পাঠাগারের বর্তমান পরিস্থিতি

নিজের জমানো টাকায় কেনা বই, ৩ বন্ধুর দেওয়া ৭টি আর এনজিওর ফেলে যাওয়া বই মিলিয়ে বিদ্যাবাতি-তে এখন বইয়ের সংখ্যা ২ শতাধিক। সারাদিন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এটি। তবে গ্রামের অনেকেই এখনও পাঠাগার কী? তা না জানায় কাজ করতে হয় মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে।

সাধ থাকলেও সাধ্যের অভাবে বুকশেলফ আর বসে পড়ার জন্য চেয়ার-টেবিল কিনতে পারেননি। হয়নি বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। তাই ভেতরে সেজে ওঠেনি বিদ্যাবাতি। পাঠকরা বই বাড়িতে নিয়েই পড়ছে। এখন দরকার প্রচুর বই আর সরঞ্জাম। বিদ্যাবাতি পূর্ণাঙ্গ পাঠাগার হিসেবে সাজিয়ে তোলতে সহায়তা কামনা করেছেন নাজমুল।

‌‘আপনার ফেলে দেওয়া বা পরিত্যক্ত বইগুলোর জায়গা হোক বিদ্যাবাতিতে, বিদ্যার আলোয় আলোকিত হোক মানুষ।’ মানুষের কাছে এই আহ্বান নাজমুলের।

এমএসআর