কোনো ধরনের স্যাটেলাইট বা তারবার্তার সংযোগ ছাড়ায় প্রকৃতির বার্তায় লক্ষ মাইল দূর থেকে নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে ছুটে আসে অসংখ্য প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। আর এসব পাখির নিরাপদ ভূমি হয়ে উঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পাখিরা সারক্ষণ মাতিয়ে রাখছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। এ যেন তাদেরই ভূমি। নামের সঙ্গে নগর যুক্ত থাকলেও ঢাকার অদূরে অবস্থিত এ ভূমিটি তুলনামূলক কোলাহলমুক্ত। ফলে পরিযায়ী পাখিদের জন্যও অনেকটা নিরাপদ আবাসস্থল এটি।

উঁচুনিচু আর লাল ভূমির বুকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে লেক বা জলাশয় আছে ২৬টি। এরমধ্যে চারটি লেকে রক্তকমল লাল শাপলার মাঝে আবাস গড়ে হাজারও পরিযায়ী পাখি। সবুজ গাছপালা আর দিনভর লেকের জলে পাখিদের ভেসে বেড়ানো আর জলকেলি খেলা চলতেই থাকে। পুরোটা সময় পাখিগুলো ছোটাছুটিতে মাতিয়ে রাখে পুরো ক্যাম্পাস।

সকালের সূর্য আর কুয়াশার ঘুম ভাঙে এসব পাখির কিচিরমিচির শব্দে যা চলে সন্ধ্যা অবধি। সন্ধ্যার পর সব লেকে নেমে আসে নীরবতা। তখন পাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কোনো গাছের ডালে আবাস গড়ে ক্ষণিকের জন্য। ভোর হতেই আবার ফিরে যায় খাবারের খোঁজে লেক আর লাল শাপলার স্পর্শে।

প্রতি বছর নভেম্বরের শেষে ও ডিসেম্বরের শুরুর দিকে উত্তরের শীতপ্রধান অঞ্চল সাইবেরিয়া, চীন, নেপাল, জিনজিয়াং, মঙ্গোলিয়া অঞ্চল থেকে খাবার ও উষ্ণতার খোঁজে নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে আসে অসংখ্য প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এ বছর শীত শুরু হতে না হতেই, অক্টোবরের শুরু থেকেই বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী পাখি আশ্রয় নিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম অতিথি পাখির দেখা মেলে। ১২৬ প্রজাতির দেশীয়, ৯৮ প্রজাতির বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ২০৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যায়। ডিসেম্বর এর শুরু থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সবচেয়ে অধিকসংখ্যক পাখি দেখা যায়।

অতিথি পাখিদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। এরমধ্যে পাতিসরালি, পান্তামুখী, পাতারি, পচার্ড, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, গার্গেনি, কোম্বডাক, পাতারী হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও ফ্লাইফেচার প্রধান।

এছাড়া লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল, কাস্তে চাড়া, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, মানিকজোড়, খঞ্জনা, চিতাটুপি, বামুনিয়া হাঁস, নাকতা, লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি নামের হাজার হাজার পাখিও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসে এই ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসে পাখির দেখা মিলছে ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার, মনপুরা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরের লেকগুলোয়।

পাখি গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্টোবর মাঝের মাঝামাঝি সময় থেকে অতিথি পাখি আসা শুরু করেছে। সাধারণত ডিসেম্বর মাসে বেশি পাখি আসে। এই সময়ে আমরা সবোর্চ্চ বেশি প্রজাতি পেয়ে থাকি।

তিনি আরও বলেন, এই বছরে যেহেতু নভেম্বরে একটা বড় সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলেছে, লোকজনের সমাগম ঘটেছে এই কারণে এখন পর্যন্ত পাখির পরিমাণ কম। তবে আশা করছি ডিসেম্বরের শেষ দিকে পাখির পরিমাণ বাড়বে।

লেকের পরিবেশের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার পর ক্যাম্পাস খোলা থাকায় লেক পাড়ে জনকোলাহল বেড়েছে। তাই পাখিদের বিচরণে যেন সমস্যা তৈরি না হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও পাখিদের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করতে হবে।

এছাড়াও ছুটির দিনে লেকেরপাড়গুলোতে অনেক বেশি লোকের সমাগম ঘটে। ফলে এই লেকগুলোতে যে পাখি বসে সেগুলো নিরাপদ বোধ করে না। দর্শনার্থীরা যাতে লেকের পাড়ে বেশি সময় না থাকে, ঠিল না ছুড়ে, কোনো ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য যাতে না ফেলে এই বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে বলে জানান তিনি।

মো. আলকামা/এমএসআর