বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) রেলস্টেশন যেন এক আক্ষেপের নাম। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক ধরে এই স্টেশনে থামে না কোনো ট্রেন। তবে স্টেশনের চেনা সেই প্ল্যাটফর্ম আজও আছে। রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় খচিত সেই নামফলকও। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও ক্যাম্পাসের স্টেশন চালু দেখতে পাওয়ার অপূর্ণতা আজও রয়ে গেছে।

বাকৃবিতে শ্রেণিকক্ষের বাইরে যেকয়টি জায়গায় শিক্ষার্থীদের প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখা যায়, সেই তালিকার একদম প্রথম দিকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যাটফর্ম। বহু বছরের পুরোনো সারি সারি গাছের ছায়া, সঙ্গে পাখিদের কলকাকলি, ধোঁয়া ওঠা চা, বাকৃবি শিক্ষার্থীদের কাছে প্ল্যাটফর্ম যেন অন্য এক ভালোবাসার জায়গা। কিছুক্ষণ পরপরই রেললাইনে বসে গল্প করা বন্ধুদের উঠে যেতে হয়, কেন না এই লাইন ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহগামী ১৫টির বেশি ট্রেন চলাচল করে। কিন্তু থামে না একটিও। কয়েক দশকের পরিক্রমায় টিকিট কাউন্টার ও সিগন্যাল ইউনিটটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় রূপ নিয়েছে।

জানা যায়, ১৯৮৭ সালে তোফাজ্জল হোসেন নামে একজন টিকিট টেকার (টিটি) উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেনের কেবিনের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ঘটনার এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তিনি নিহত হন। এরপর সারাদেশে রেলস্টেশনগুলো ৩৬ ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে। বন্ধ থাকে বাকৃবির রেলস্টেশনটিও। পরে বাকি সব রেলস্টেশন চালু হলেও আজ পর্যন্ত চালু হয়নি এই স্টেশন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশ থেকে আসা প্রায় সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়ন করছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা তিন সহস্রাধিক। এছাড়া ক্যাম্পাসের পাশেই রয়েছে কয়েকটি গ্রামের প্রায় ২০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। রেলস্টেশনটি চালু করা গেলে তাদেরও ভোগান্তি অনেকটা কমে যেত। কারণ ময়মনসিংহ জেলার সঙ্গে আশপাশের জেলার সড়ক ব্যবস্থা বেহালের কারণে রেলপথই হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র নিরাপদ মাধ্যম। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মচারীসহ সবার পছন্দ রেলপথ।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে রেলস্টেশন অথচ ট্রেনে ওঠার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রায় ছয় কিলোমিটার যানজটের মধ্য দিয়ে শহরে যেতে হয়। ভোরের ঢাকাগামী ট্রেন ধরতে পারে না তারা। কারণ ভোরবেলা শহরে যাওয়ার জন্য কোনো যানবাহন থাকে না। আবার মধ্যরাতের ট্রেন যখন শহরে থামে তখন ক্যাম্পাসে ফেরার পথে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয় অথবা যানবাহন না পেয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে আসতে হয়।

শুধু তাই নয়, ট্রেনে সিট পেতে হলে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ দিন আগে শহরের ময়মনসিংহ স্টেশনে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। পরে গেলে আর টিকিট পাওয়া যায় না। তখন কালোবাজারিদের কাছ থেকে কয়েকগুণ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। 

বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের ভিপি ইমতিয়াজ আবির বলেন, বর্তমানে চাকরির বেশির ভাগ পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের ঢাকা যেতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষা দিয়ে আসতে আসতে গভীর রাত হয়ে যায়। আর রাতে শহর থেকে ক্যাম্পাসে আসতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের যানবাহন স্বল্পতার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তেমনি ছিনতাইকারীদের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে।

সবচেয়ে বেশি সমস্যার শিকার হয় মেয়েরা। অথচ ঢাকাগামী প্রত্যেকটি ট্রেন আমাদের ক্যাম্পাসের ওপর দিয়েই যাতায়াত করে। কর্তৃপক্ষ চাইলেই শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে বাকৃবি স্টেশনটি সচল করতে পারে। বর্তমানে এটি এখন দর্শনার্থীদের ছবি তোলার স্থানে পরিণত হয়েছে। 

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেমু ট্রেন চালু করতে রেল মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন পার হলেও বাকৃবিতে সেই ডেমু ট্রেনটিও চালু হয়নি। রেলস্টেশন চালু করতে সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার পরিষদের সভাপতি মো. লুত্ফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাহবুবুর রশীদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি রেজিস্ট্রার বরাবর দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে সব ধরনের ট্রেনে বাকৃবি স্টেশনে যাত্রী ওঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করা হয়।

কিন্তু কোনো ফল মেলেনি। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল তাদের ইশতেহারে রেলস্টেশনটি চালু করার বিষয়টি উল্লেখ করে। কিন্তু যে দলই নির্বাচিত হোক না কেন, তাতে রেলস্টেশনটি আর সচল হয় না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বলেন, রেলস্টেশনটি চালু হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার মানুষের ভোগান্তি অনেকখানি কমে যেত। তাই রেলস্টেশনটি চালু করার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই রেলস্টেশনটি চালু করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। 

এসপি