ক্লাসরুমে বসে উসখুস করছে নাজিয়া। রুমে সে ছাড়া আর কেউ নেই। সুইটিটা এখনো আসছে না কেন! স্কুলে ঢোকার মুখে আচারওয়ালাকে চালতার আচার নিয়ে বসে থাকতে দেখে এসেছে। টুকটুকে লাল রঙের আচার। দেখেই কেমন জিভে জল চলে এসেছিলো। প্রিয় সুইটিকে রেখে একা একা খাবে না বলেই তার জন্য অপেক্ষা। অথচ তার আসার নামগন্ধ নেই। আচারওয়ালা যদি চলে যায়? ওদিকে আকাশে মেঘ করেছে। মেঘ দেখলেই নাজিয়ার ভীষণ ভয় লাগে। সে পড়ে ক্লাস থ্রিতে। স্কুল থেকে দশ মিনিট হাঁটলেই তাদের বাসা। মাঝখানে একটা বাজার, রাজ্যের দোকানপাট, একটা রিকশাস্ট্যান্ড। এটুকু পথ সে একা একাই হেঁটে আসে।

কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা ক্লাসরুমে একা একা বসে থেকে নাজিয়ার একটু ভয় লাগে যেন। সুইটি এখনো আসছে না! ঝড়-বৃষ্টি আসবে ভেবে অন্যরাও হয়তো আজ ক্লাসে আসেনি। নাজিয়া আরেকবার স্কুলের গেটের দিকে তাকায়। ওইতো সুইটিকে দেখা যাচ্ছে। তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে সুইটি। ওকে দেখতে আস্ত ক্যাঙারুর মতো লাগছে!

তারা দু'জনই সমবয়সী, সুইটির জন্য তার খুব মায়া। সুইটির মা নেই। ওদের ইংলিশ টিচার লতিফা ম্যাডাম খুব ভালো গান গাইতে জানেন। মাঝে মাঝে ক্লাসে গান গেয়েও শোনান। যেদিন লতিফা ম্যাডাম 'মা আমার সাধ না মিটিলো' গানটি গেয়েছিলেন, সুইটি সেদিন কী কান্নাটাই না করেছিলো! অতোটুকু মানুষ আর তার কতো বড় দুঃখ; আহা রে!

মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় নাজিয়ার। তখন সুইটির কথা মনে পড়ে। বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদে নাজিয়া। মাকে ছাড়া ও কেমন করে থাকে! একদিন নাজিয়ার ছোট খালামণি তাকে নিয়ে গিয়েছিলো খালামণির বাসায়। দিনের বেলাটা খালাতো ভাইবোনের সঙ্গে খেলা করে কেটে গিয়েছিলো। কিন্তু রাত হতেই শুরু হয় কান্না। মাকে ছাড়া সে কী করে ঘুমুবে! পরদিন ভোরে ছোট মামার সঙ্গে চলে এসেছিলো নিজেদের বাসায়, মায়ের কাছে। আর সুইটি! কখনোই তো সে তার মায়ের কাছে যেতে পারে না!

সুইটি কাছে আসতেই নাজিয়া বললো, ‘চল, আচার কিনে খাই। এতোক্ষণে আচারওয়ালা চলে গেলেন কি-না, কে জানে!’ সুইটি বললো, ‘না না, যায়নি। আমি তো এক্ষুনি দেখে এলাম।’ নাজিয়া বললো, ‘চল, যাই।’

টুকটুকে চালতার আচার কিনে তা মুখে দিতে না দিতেই ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করে উঠলো আকাশ। আকাশের হুঙ্কারে ভীষণ ভয় পেয়ে স্কুলের দিকে দৌড় শুরু করে তারা। তবে আচার ফেললো না, বরং আরও শক্ত করে হাতে ধরে রাখলো।

তুমুল বৃষ্টি দেখে ভয়ে দুজন থরথরিয়ে কাঁপছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড টিচার ওদেরকে তার রুমে নিয়ে বসালেন। এর মধ্যে শুরু হয়েছে আরেক সমস্যা। সুইটি তবু চুপচাপ বসে আচার খেতে লাগলো, নাজিয়া শুরু করেছে কান্নাকাটি! চালতার আচার তার খুব প্রিয়; তবু না খেয়ে ভ্যা! সুযোগ পেয়ে সুইটি নাজিয়ার ভাগের আচারটুকুও খাওয়া শুরু করলো। নাজিয়া সেদিকে তাকিয়েও দেখলো না।

স্যার তার মন ভালো করাতে গল্প বললেন। ছবিওয়ালা একটা গল্পের বইও বের করে দেখালেন। নাজিয়ার কান্না থামেই না। তার একটাই কথা, ‘আম্মুর কাছে যাবো, আম্মু নিশ্চয়ই আমার জন্য কান্না করছে!’

স্যার বললেন, ‘বৃষ্টি থামলে আমিই তোমার আম্মুর কাছে নিয়ে যাবো।’ নাজিয়া তবু কান্না করেই চললো। সেদিন আর কোনো ক্লাস করতে হলো না।

বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গে নাজিয়ার কান্নাও থেমে গেলো। স্যার বললেন, ‘কী গো মামণি, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে?’ নাজিয়া ফ্রকের কোণে চোখ ভালো করে মুছে নিয়ে বললো, ‘না না, আমি একাই যেতে পারবো।’

স্কুলের গেট থেকে বেরিয়েই ওরা দেখলো সুইটির দাদুভাই ছাতা নিয়ে সুইটিকে এগিয়ে নিতে এসেছেন। সুইটি দৌড়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরলো। দাদুভাইও একগাল হেসে প্রিয় নাতনিকে বুকে চেপে ধরলেন। এমন দৃশ্য দেখে নাজিয়ার একটু মন খারাপ হলো। তার তো দাদুভাই নেই। থাকলে নিশ্চয়ই তিনিও এমন করে ওকে এগিয়ে নিতে আসতেন! নাজিয়াদের বাড়ির সামনে দিয়ে সুইটিদের বাড়ি যেতে হয়। ওরা এক পথ দিয়েই যাচ্ছিলো। আর বৃষ্টি কী হতচ্ছাড়া, তখনই আবার ঝমঝম করে ঝরতে শুরু করলো! সুইটি তার দাদুভাইয়ের সঙ্গে ছাতা মাথায়, আর তার পাশে নাজিয়া ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগলো।

নাজিয়ার আবার খুব কান্না পেলো। এবার আর ভয়ে নয়, দুঃখে। সে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে লাগলো। তার চোখের পানি বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, কেউ তার কান্না দেখছে না। যদিও আকাশে সূর্যের দেখা নেই, তবু এখন মধ্য দুপুর। আম্মু নিশ্চয়ই রান্না করছেন, আব্বু অফিসে, ভাইয়া স্কুলে। নাজিয়ার তো দাদুভাই নেই। কেউ তাকে ছাতা হাতে এগিয়ে নিতে আসেনি!