চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার চিৎলা ইউনিয়নের কুলপালা গ্রামের সফল খামারি জাকির হোসেন। একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনাকালে ২০০২ সালের ২৯ মার্চ মেজো ভাই জয়নাল আবেদিনের দেওয়া মাত্র ১৬০০ টাকা দিয়ে ২০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে ছোট্ট খামার করেছিলেন। অনেক চড়াই-উতরাই আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আজ সেই খামারটি জেলার সবচেয়ে বড় হাঁসের খামারে রূপ নিয়েছে। এখন জাকির হোসেন কোটি টাকার মালিক।

মেসার্স জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্স মিক্সড এগ্রো ফার্ম অ্যান্ড হ্যাচারি নামে বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। এলাকার প্রায় ৩০০ পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে তার প্রতিষ্ঠানে। কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় ১৫০ বিঘা জমির ওপর মেসার্স জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্স মিক্সড এগ্রো ফার্ম অ্যান্ড হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। ৩০ হাজারের বেশি বেইজিং ও খাকি ক্যাম্বেলসহ চার জাতের জাতের হাঁস রয়েছে সেখানে। এই হাঁস থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৯-২০ হাজার ডিম পাওয়া যায়। বর্তমানে খামারটিতে ১৯টি হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটর মেশিন রয়েছে। এসব ইনকিউবেটর থেকে প্রতি মাসে ছয় লাখের মতো বাচ্চা ফোটানো হয়। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন ভোরে হাঁসের বাচ্চা কেনার জন্য খামারিদের লম্বা লাইন লেগে যায় এই খামারে। 

হাঁসের পাশাপাশি ভেড়ার খামারও গড়ে তুলেছেন জাকির হোসেন। সেই খামারেও রয়েছে ২২০টির মতো ভেড়া। এর সঙ্গে মাছচাষ ও কোয়েল-কবুতর পালন করেন। এগুলো দেখাশোনা এবং পরিচর্যার জন্য জাকির হোসেনের খামারে কাজ করছেন তার চার সহোদরসহ বেতনভুক্ত ৪০ জন কর্মচারী। 

তিনি খামারে গড়ে তুলেছেন প্রশিক্ষণ সেন্টার। সেখানে হাঁস খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৩০০ খামারিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাকির হোসেন। তার খামার দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেকার যুবকসহ ছোট ছোট খামারিরা আসেন। তাকে দেখে এলাকার অনেক বেকার যুবক হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন।

জানা গেছে, কুলপালা গ্রামের আবদুর রশীদ মোল্লা ও আজিমুন্নেছা দম্পতির আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে সপ্তম জাকির হোসেন। তার বাবা ছিলেন সামান্য বর্গাচাষি। 

সফল খামারি জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০০২ সালে তিনি যখন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন তখন লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু একটা করার কথা ভাবতে থাকেন। সেই ভাবনা থেকে পার্শ্ববর্তী রুইতনপুর গ্রামে হাঁসের খামার দেখতে যান। তখন তিনি ওই খামারির কাছে হাঁস পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে তাকে সহযোগিতা না করে অপমানিত করা হয়। 

এরপর থেকেই হাঁস পালনের জেদ চেপে বসে জাকিরের মনে। সেখান থেকে ঘুরে এসেই তিনি দেখা করেন চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অজয় কুমার রায়ের সঙ্গে। তার পরামর্শে জাকির হোসেন খুলনার আঞ্চলিক হাঁস উৎপাদন খামারে যান, তার মেজো ভাইয়ের দেওয়া মাত্র ১ হাজার ৬০০ টাকা নিয়ে। ওই টাকায় খাকি ক্যাম্বেল ও জিনডিং জাতের ২০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে বাড়ি ফেরেন। এ দেখে প্রতিবেশীরা হাসাহাসি করলেও সেদিকে কান দেননি জাকির। বাড়ির উঠানে গড়ে তোলেন ছোট্ট খামার। পাশাপাশি চলতে থাকে তার লেখাপড়া। ২০০৩ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। এরপর চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে বিবিএতে ভর্তি হলেও আর পড়াশোনা হয়নি তার। 

জাকির হোসেন বলেন, খামারের পাশাপাশি একটি পানের হাটে সপ্তাহে দুদিন দিন প্রতি ৮০ টাকা বেতনে হিসাবরক্ষণের কাজ করতাম। এরই মধ্যে পরম যত্নে পালন করা হাঁসগুলো ডিম দিতে শুরু করে। প্রতিদিন ৭-৮ টাকার ডিম বিক্রি করতাম। পানের হাটে কাজ বাদ দিয়ে হাঁসের খামারের প্রতি মনোযোগ দেই। এর মধ্যে বেশ কিছু হাঁস অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তবুও আমি হাল ছাড়লাম না। আস্তে আস্তে জ্বলতে থাকে আশার আলো। স্বপ্ন পূরণ হতে থাকে আমার। বর্তমানে আমার চার ভাই এই খামারের বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন। 

তিনি বলেন, আমার এখানে আসা খুব সহজ ছিল না। ধৈর্য ও কঠোর পরিশ্রমের ফল আজকের এই খামার। তবে স্বল্প পুঁজি নিয়েও হাঁসের খামার করা যায়। 

বেকার যুবকদের উদ্দেশে জাকির বলেন, আমাদের দেশে দিন দিন বেকারত্ব বাড়ছে। সবাই চারির পেছনে ছুটছে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজ উদ্যোগে স্বল্প পুঁজিতে বিভিন্ন ধরনের খামার গড়ে তুলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।

খামারের ম্যানেজার ইয়াছিন শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খামারটিতে সাত বছর ধরে কাজ করছি।  সে সময় খামারটি এতো বড় ছিল না। ধীরে ধীরে খামার বড় করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে ৩০ হাজারের বেশি চার প্রজাতের হাঁস আছে। পাশাপাশি খামারটিতে  টার্কি মুরগি, কোয়েল পাখি, ছাগল, ভেড়া ও মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও রয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ১৬০০ টাকা দিয়ে শুরু করে জাকির এখন সফল খামারি। প্রতি মাসে ছয় লাখের ওপরে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন হয় এখানে। শুধু চুয়াডাঙ্গায় নয় মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলায় এ হাঁসের বাচ্চা সরবরাহ করা হয়। আমরা তাকে সব সময় সহযোগিতা করি। করোনার কারণে খামারটি লোকসানের মুখে পড়েছিল। সে সময় সরকারিভাবে প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও তিনি সফল খামারি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন।
 
আরএআর