দুই বছর বয়সে পোলিও রোগে ডান পায়ে সমস্যা দেখা যায়। শুরু হয় চ্যালেঞ্জিং জীবন। শুনেছেন অনেক কটু কথা। তবুও থেমে থাকেননি। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা আর দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণে আজ তিনি একটি উপজেলার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি হলেন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল করিম সাত্তার। 

আব্দুল করিম সাত্তার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাশিমপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শেষ করে কাশিমপুর এ কে ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে রাজশাহী নিউ গভমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে রাজশাহী কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। 

এরপর ৩১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। ২০১৩ সালে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রবেশনার হিসেবে যোগদান করেন৷ পরে রংপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, নওগাঁ জেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিবন্ধকতা আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সমাজের বোঝা না হয়ে যে সম্পদ হওয়া যায় আব্দুল করিম সাত্তার সেই গল্পই করেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।

ঢাকা পোস্ট : কখন থেকে আপনার পায়ের সমস্যা?

ইউএনও করিম : মাত্র ২ বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হই। পরে আমার ডান পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক বলেছিলেন, এভাবেই ফিজিওথেরাপি নিয়ে যতটুকু ভালো থাকা যায়।

ছোটবেলায় পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় যাতায়াত করতে হতো। ধীরে ধীরে পায়ে হাত রেখে চলার চেষ্টা করি। হাঁটতে গিয়ে অনেকবার পড়ে গিয়েছি। আমার খুব মনে পড়ে, স্কুলে যাওয়ার সময় অনেকবার বইসহ মাটিতে পড়ে গিয়েছি। এতে আমার বই-খাতা ভিজে গেছে। পরে আমি মোটা মলাট ব্যবহার করতাম, যাতে পড়ে গেলেও আর বই-খাতা না ভিজে। তারপর দীর্ঘ চেষ্টার পর পায়ে হাত রেখে হাঁটার অভ্যাস করি।

ঢাকা পোস্ট : পরিবারের সদস্যরা কেমন সহযোগিতা করেছেন? 

ইউএনও করিম : যেহেতু আমি হাঁটাচলা করতে পারতাম না সে কারণে পরিবারের সদস্যদের সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হতো। বাবা-মা সব সময় আমাকে অন্য ভাই-বোনদের মতো দেখেছে। প্রতিবন্ধী বলে কখনো বলত না ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না’। তাদের সহযোগিতায় আজ এতদূর আসতে পেরেছি। 

ঢাকা পোস্ট : নিশ্চয়ই অনেকের কটু কথা শুনেছেন?

ইউএনও করিম : সমাজ এখনো প্রতিবন্ধী মানুষদের আলাদা চোখে দেখে। কিছু মানুষ মানসিকভাবে সমর্থন দিলেও অধিকাংশ মানুষ আলাদাভাবে দেখত। কেউ কেউ চাইত শারীরিকভাবে অক্ষম অন্য মানুষদের মতো করে আমি যেন জীবিকা নির্বাহ করি। অন্যের সহযোগিতা নিয়ে বাঁচি। তবে আমি আমার পরিবারের অনেক সমর্থন পেয়েছি। তাই পিছপা হইনি। 

ঢাকা পোস্ট : শিক্ষকরা কেমন সহযোগিতা করেছেন? 

ইউএনও করিম : শিক্ষকরা আমাকে পর্যাপ্ত সমর্থন দিয়েছেন। তারা অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে আমার যত্ন নিতেন বেশি। তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমার এই পর্যায়ে আসা সম্ভব ছিল না।

ঢাকা পোস্ট : যারা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তাদের বিষয়ে কিছু বলবেন?

ইউএনও করিম : শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় অনেকেই কাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। তারা নিজেদের সমাজের বোঝা মনে করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ একজন মানুষকে সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলেন না। আবার এও মনে রাখতে হবে, আপনার শারীরিক অক্ষমতা আছে কিন্তু আপনার কোনো না কোনো যোগ্যতাও আছে। যেটার মাধ্যমে আপনি আপনার জীবনকে এগিয়ে নিতে পারবেন। আমি দেখেছি, অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাই-বোন সুন্দর করে গান করতে পারেন। কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারেন।

ঢাকা পোস্ট : শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে একজন ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন? 

ইউএনও করিম : পেশাগত জীবনে শিক্ষকতা করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিও। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে এখন আরো বেশি খুশি। এটি খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ, তবে উপভোগ্য। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ আছে। সমাজের অসহায়, দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমি নিজেই একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাই শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছি। 

ঢাকা পোস্ট : ঢাকা পোস্টকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ইউএনও করিম : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।


এসপি /এমএএস/জেএস