কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেশের অন্যান্য জেলার মতো রংপুরেও আমলে নিচ্ছে না কেউ। ফলে গত ১০ বছরে কৃষিভিত্তিক এ জেলায় ৬ হাজার ৬৩১ হেক্টর অর্থাৎ ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮৫৭ শতাংশ কৃষিজমি চলে গেছে অকৃষি খাতে। এটি কৃষি বিভাগের সরকারি হিসাব হলেও বাস্তবে তা চার গুণ ছাড়িয়ে যাবে।

জেলার বিভিন্ন এলাকার দুই ও তিন ফসলি জমিতে ভারী ও হালকা শিল্পকারখানা, নামিদামি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে ইটভাটা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসন প্রকল্প। এ ছাড়া বসতবাড়িসহ গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অবকাঠামো।

অথচ কৃষিজমি অক্ষত রেখে উন্নয়নের জন্য বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ করে দুই ও তিন ফসলি জমি সংরক্ষণে তার জোরালো নির্দেশনা ছিল। কৃষিজমি সুরক্ষায় নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর তাগাদা উপেক্ষা করেই উন্নয়নের নামে কৃষকের স্বপ্ন ধ্বংস করা হচ্ছে।

রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের কোলঘেঁষা মিঠাপুকুর উপজেলা। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই কৃষিনির্ভর। আমাদের গন্তব্য এ উপজেলায়। রংপুর নগরীর দমদমা ব্রিজ পার হলেই মিঠাপুকুরের সীমানা শুরু। চলতে চলতে চোখে পড়ল কৃষিজমির মাঝে বিশাল একটি ভবন। এটি প্রাণ-আরএফএল গ্রপের একটি বাণিজ্যিক স্থাপনা, যেখান থেকে বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী বিপণন করা হয় এ অঞ্চলে। ওই পথ ধরে একটু সামনে এগোলে দেখা গেল একটি স্থাপনা থেকে কালো ধোঁয়া উড়ছে।

বিষয়টি কী, স্থানীয় কয়েকজন কৃষককে জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, এমন ধোঁয়া সারাদিনই ভেসে বেড়ায়। অনবরত একটা শব্দও কানে লাগে তাদের। কাছে গিয়ে দেখি, ওই কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্প কেন্দ্র থেকে। ঠিক ওই কেন্দ্রের বিপরীতে জমির মাটি ভরাট করে কাঁটাতারে ঘিরে রেখেছে স্কয়ার ফুড বেভারেজ। পরে মহাসড়ক ধরে যেতে যেতে বিভিন্ন বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, জমি কেনার সাইনবোর্ড নজরে পড়ে। এসব জমির এপাশ-ওপাশ শুধুই খেত আর খেত।

কনফিডেন্স পাওয়ার নামের ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনের বাঁ দিকে জমিতে শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি ছেড়ে কাজ করছিলেন এক বৃদ্ধ কৃষক। আমরা তার কাছে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমিতে চায়না ধান রোপণ করছেন তিনি। শামছুল হক নামের এই কৃষক প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে চাষাবাদ করেন এখানে।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে এই জমিতে চায়না ধান, আলু, তামাক চাষ করেছি। এখন তামাক বাদে সারা বছরই এসব ফসল আবাদ করি। কিন্তু এখানে ‘কনফিডেন্স পাওয়ার’ নামে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হওয়ার পর থেকে ফলন আগের মতো পাই না। তাতে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল-মবিল ও কালো ধোঁয়া কৃষিজমির ফসলে এসে পড়ছে। এ কারণে ফসলের ডগা কালো হয়ে গাছ মরে যাচ্ছে। আমাদের স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জমি বিক্রি করে সাময়িক লাভবান হয়েছে। কিন্তু আমরা বেশির ভাগ কৃষকই এখন ক্ষতির মুখে।

কৃষক শামছুলের ভাষ্য অনুযায়ী মিঠাপুকুরে এমন অনেক কৃষিজমি এখন অকৃষি খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এসব জমির মালিকদের জমি বিক্রি করতে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন এনামুল হক নামের এক মধ্যস্থতাকারী। জমি বিক্রির মাধ্যম হয়ে কাজ করাটাই নাকি এনামুলের পেশা।

এনামুলের খোঁজ করতে গিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি এসব কৃষি জমি? উত্তর মেলানোর আগে আমরা এসব জমির প্রকৃত মালিকদের (জমি বিক্রেতা) খুঁজতে বৈরাগীগঞ্জ চূহড় গ্রামে যাই। সেখানে একটি মুদি দোকানে দেখা হয় আবুল হাশেম (ছদ্মনাম) নামের একজনের সঙ্গে। তিনিও কনফিডেন্স পাওয়ারকে জমি দিয়েছেন। তবে সেই জমি নিয়ে পারিবারিক মামলা-মোকাদ্দমা ছিল বলে জানান তিনি। সম্প্রতি স্কয়ার ফুড বেভারেজও তার কাছ থেকে কিছু জমি কিনে নিয়েছে।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা পরিবারের কয়েকজন মিলে প্রায় তিন একর (৩০০ শতক) জমি বিক্রি করেছি। বাপ-দাদার আমল থেকে জমি আবাদ করছি। এখন সবাই যখন পাওয়ার কোম্পানিকে জমি দিচ্ছে, তাই বেকায়দায় পড়ে আমরাও জমি বিক্রি করেছি। যেদিন ওই জমির ওপর মাটি ভরাট হয়, সেদিনও জমিতে ধান ছিল। গ্রামের মানুষ সেই ধান কেটে নিয়ে গরুকে খাইয়েছে।

জমি কেনাবেচার মাধ্যম হয়ে কাজ করেন স্থানীয় এনামুল হক। তার ফাঁদে পড়েই বেশির ভাগ কৃষক জমি বিক্রি করেছেন বলে দাবি হাশেমের। তার তথ্যমতে, রেজিস্ট্রি অফিসে কৃষিজমি বলতে হয় না। ওখানে খতিয়ান, দাগ, মৌজা তারপর উঁচু-নিচু (দোলা-ডাঙ্গা) এসব দেখে জমি রেজিস্ট্রি হয়। কোন জমিতে আবাদ হবে, আর কোনটাতে হবে না, এ ধরনের কিছু বোঝার সুযোগ থাকে না। এ সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো।

আমরা এনামুলের সঙ্গে দেখা করার জন্য যাই। উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নে আমরা যাই এনামুলের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তাকে পাই। এলাকার বেশির ভাগ কৃষিজমি ঢাকার বড় বড় কোম্পানিকে পাইয়ে দিতে কাজ করেন তিনি। এ কারণে এলাকার মানুষ তাকে ‘মিডিয়া’ বলে ডাকে। তার প্রলোভনে পড়ে একটু বাড়তি দামের আশায় স্থানীয় কৃষকদের অনেকেই তাদের জমি বিক্রি করেছেন।

প্রথমে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে প্রথমে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন এনামুল। পরে তার মাধ্যমে অন্য একটি কোম্পানির জন্য ৩০ থেকে ৩৫ একর জমি কেনার প্রস্তাব দিলে সুর নরম করে তথ্য দিতে শুরু করেন। এরপর বাড়ির বাইরে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতেও রাজি হন তিনি।

তার মাধ্যমে কী পরিমাণ জমি বিক্রি হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মিঠাপুকুর থানায় সরকারি-বেসরকারিভাবে নতুন সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে প্রায় দেড় শ একর (১৫ হাজার শতক) কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। এখানকার ইসলামপুর মৌজায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, এর ডান পাশে কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেড, বিপরীতে স্কয়ার ফুড বেভারেজ, এর সামনে চায়নিজ একটি কোম্পানি জমি কিনেছে। এগুলোর সবই কৃষিজমি ছিল, সেখানে নিয়মিত আবাদ হতো।’

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে কীভাবে কৃষিজমি কেনাবেচা সম্ভব, উত্তরে তিনি দায় স্বীকার করে বলেন, ‘আমি নিজেও এসব কাজে জড়িত ছিলাম। ওরা (কোম্পানিগুলো) প্রথমে কৃষিজমিগুলোকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের (ডিসি অফিস) মাধ্যমে টাকাপয়সা দিয়ে অকৃষি খাত বা এক ফসলি দেখিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে নেয়। তারপর পর্যায়ক্রমে জমিগুলো কেনাবেচা হয়। বিক্রেতারা (জমির মালিক) তো এত কিছু বোঝে না। তারা মূলত এলাকার উন্নয়ন ও জমির দাম একটু বেশি পাবেন আশায় বিক্রি করে দেয়।’

এনামুলের দাবি, ‘সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষিজমি কিনছে, তারাই সরকারের নির্দেশনা অমান্য করছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা ডিসি অফিসে ঘুষ দিয়ে কৃষিজমিকে অকৃষি হিসেবে অনুমোদন নেন। পরে সেই জমিতে মাটি ভরাট করে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করছে। তা ছাড়া এলাকার লোকেরা তো শুরুতে বুঝতে পারে না, তাদের জমিতে কোম্পানিগুলো কী করবে।’

এনামুল বোঝালেন যে কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে সমস্যায় পড়তে হয় না ক্রেতা-বিক্রেতাকে। কারণ, জমির কাগজে সুনির্দিষ্ট করে লেখা নেই কোনটি কৃষি আর কোনটি অকৃষি। তবে স্থানীয় অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন কৃষক আর ২৫ জন জমি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে আমরা নিশ্চিত হই, এসব একসময় কৃষিজমি ছিল। স্থানীয় কৃষক খায়রুল ও সালেফ উদ্দিনের সঙ্গে আমরা কথা বলি। সম্পর্কে দুজন বাবা-ছেলে সারা দিন কৃষিকাজ নিয়ে মাঠে ব্যস্ত সময় কাটান। মহাসড়কের পাশের বেশ কিছু জমিতে তারা চাষাবাদ করেন।

সালেফ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষ এসব জমিতে আবাদ করেছেন। এখন আমরা আবাদ করি। সারা বছর কোনো না কোনো ফসল আবাদ হয়ই। কোনো সময়ই ফাঁকা থাকে না। এসব জমিতে মরিচ, পাট, ভুট্টা, ধান, শসা, আলুসহ বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদন করা হয়। আমাদের আগে ফসল ভালো উৎপাদিত হতো, এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাবে তা হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন যেসব প্রতিষ্ঠান এই এলাকায় গড়ে উঠেছে, তার সবই কৃষিজমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করে জমি ক্রয় করেছে। যারা জমি বিক্রি করছে, তারা হয়তো অন্য কোথাও গিয়ে আবার জমি কিনে আবাদ করছে, কিন্তু আমরা ক্ষতির মধ্যে আছি। এভাবে কৃষিজমি যদি কমতে থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতে তো অনেক সমস্যা দেখা দেবে। এ জন্য মুখের কথায় নয়, বাস্তবসম্মত আইন করে সরকারকেই তা কার্যকর করতে হবে।’

ঘটনার সত্যতা জানতে ও কথা বলকে আমরা যাই কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেডের কার্যালয়ে। পরিচয় জানতে পেরে আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেননি সেখানকার নিরাপত্তা প্রহরীরা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা হয় সেখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হায়াতের সঙ্গে। তিনিও ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন।

পরে জানতে চাই কৃষিজমিতে এ রকম প্রকল্প কীভাবে করা হলো? এর উত্তরে হায়াত বলেন, ‘এখানকার উৎপাদিত ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন। আমরা সরকারের ওপর মহলসহ ডিসি অফিস, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিয়েছি। এই জমিগুলোকে তারা অকৃষি হিসেবে অনুমোদন করেছে।’

কনফিডেন্স পাওয়ার থেকে রওনা হই জায়গীরহাটে এসএ গ্রুপের অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি এলাকার উদ্দেশে। কিন্তু সেখানে কেউই জমি ক্রয়-বিক্রয় প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি ভেরে-বাইরে ছবি তোলা নিয়েও প্রতিষ্ঠানটির প্রবেশদ্বারে থাকা দু-একজন আপত্তি জানান। একই পরিস্থিতি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ঘটে। জমি কেনার পর প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ নামে সাইনবোর্ড সাঁটানো ছাড়াও দেখাশোনার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের পাশাপাশি আছে ঢাকা থেকে আসা বিশ্বস্ত কর্মচারীরা। তারা দায়িত্বে থাকলেও ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি ছাড়া নিজেদের নাম-পরিচয় বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

জমি বিক্রেতা ও স্থানীয় কৃষক ছাড়াও বিভিন্নজনের তথ্যসূত্র ধরে আমরা ভূমি অফিসে খোঁজ করি। আমাদের হাতে আসা বেশ কিছু জমির কাগজপত্র ও কিছু সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, মিঠাপুকুরের চূহড় ইসলামপুর মৌজায় ৪৫ থেকে ৪৮ হাজার টাকা মূল্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ প্রায় ৯ একর কৃষিজমি কিনেছে। পায়রাবন্দ বাসস্ট্যান্ডের পাশে দেশের বৃহৎ এই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি তাদের একটি ডিপো তৈরি করেছে সেখানে। একই এলাকার ইসলামপুর মৌজায় ডিউরেবল প্লাস্টিক লিমিটেডের নামে আরএফএল গ্রুপ আরও কয়েক একর জমি কিনেছে।

এ ছাড়া পায়রাবন্দের চূহড় লোহনী মৌজায় ৬০ থেকে ৬৫ জন বিক্রেতার কাছ থেকে ২০১৭ সালে শতকপ্রতি ৫৬ হাজার টাকা মূল্যে ১৩ একর জমি কিনেছে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্প কনফিডেন্স পাওয়ার। এর বিপরীত দিকে চূহড় মৌজায় ৯ একর জমি কিনেছে স্কয়ার ফুড ব্যাভারেজ, যার গড় মূল্য প্রতি শতকে পড়েছে ৮০ হাজার টাকা। একই এলাকার জয়রামপুর আনোয়ার মৌজায় শতকপ্রতি ৬৯ থেকে ৭৫ হাজার টাকা মূল্যে প্রায় ১৩ একর জমি কিনেছে চায়নিজ একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া সেখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে জায়গীয় এলাকায় প্রায় ৯ একর জমিতে এসএ গ্রুপ তাদের অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে।

কৃষিজমি এভাবে অকৃষি খাতে ব্যবহারের চিত্র শুধু মিঠাপুকুরে নয়, পুরো রংপুর জেলার আট উপজেলা এবং রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায়ও একই অবস্থা। তবে মিঠাপুকুরের পর তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে নেই পীরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, পীরগাছা ও রংপুর সদর উপজেলা। এসব এলাকায় বিভিন্নভাবে কয়েক হাজার হেক্টর কৃষিজমি এখন অকৃষি খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমরা মিঠাপুকুর থেকে রংপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে খেয়াল করেছি, এই নগরীর বর্ধিত জনগোষ্ঠীর আবাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে ফসলি জমি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য কাঁচা-পাকা বাড়ি। নগরায়ণের ফলে রাস্তার পাশে অনেক ফসলি জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ছোট ছোট মার্কেট। কোথাও কোথাও নির্মাণ করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কার্যালয়। শহরতলি থেকে একটু দূরের গ্রামীণ জনপদেও এখন হাউজিং ব্যবসার রমরমা কারবার চলছে।

রংপুর নগরীর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাস্টারপাড়া, দাওয়াইটারী, মিস্ত্রিপাড়া, টেপাটারী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যেসব জমিতে ধান, পাট, আলু, সরিষা, গমসহ বছরে তিনটি ফসল উৎপাদিত হতো, এখন সেসব জমিতে কাঁচা-পাকা বাড়ি নির্মাণ করে গড়ে উঠেছে জনবসতি, দোকানপাট ও সড়ক। আবার নামে-বেনামে সাঁটানো হয়েছে বিভিন্ন নামে আবাসন কোম্পানির প্লট বরাদ্দের বড় বড় সাইনবোর্ড। এই এলাকাগুলো সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকা, আগে এসব এলাকা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাহারকাছনা সিগারেট কোম্পানি এলাকার মতি মিয়া বলেন, আট-দশ বছর আগেও তার বাড়ির আশপাশে ধান, পাট, আলুসহ শাকসবজির আবাদ হতো। রংপুর বিভাগ ও সিটি করপোরেশন হওয়ার পর জমির দাম বেড়ে গেছে। এখন কৃষিজমিগুলোতে আবাসনব্যবস্থা গড়ে উঠছে। ফলে অনেকেই চাষাবাদের জমি বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছেন।

নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাবুখা এলাকার আহসান হাবিব বলেন, আমাদের এলাকায় বেশির ভাগ আবাদি জমি ছিল। সেই জমিগুলোতে এখন অনেকে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন। কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছেন। গ্রামের ভেতরে এখন বহুতল ভবনের সংখ্যাও কয়েক গুণ বেড়েছে। কৃষিজমি কমতে থাকায় এলাকায় এখন আগের মতো চাষাবাদ হয় না।

আবার কেউ কেউ চাষাবাদের জন্য জমি বরাদ্দ নিয়ে সেখানে গড়েছেন বাণিজ্যিক অবকাঠামো। অনুসন্ধানে তেমন তথ্যই মিলেছে রংপুর সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দ দেওয়া চিকলি ওয়াটার পার্ক ঘিরে। একজন প্রভাবশালী আইনজীবী তিন বছরের জন্য হনুমানতলা পার হয়ে চিকলি-সংলগ্ন ব্রিজের পাশে চাষাবাদের জন্য তিন একর জমি ইজারা নেন। কিন্তু এখন সেখানে চাষাবাদের বদলে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক বিনোদন কেন্দ্র।

ফসলি জমির অপব্যবহার রোধে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে। ভূমি রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপন, নদীভাঙনসহ নানা কারণে প্রতিবছর রংপুর জেলায় কৃষিজমি কমছে। খাল-বিল ভরাট, অপরিকল্পিত ইটভাটা স্থাপনও এর জন্য দায়ী। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।

কৃষি আন্দোলনকারী পলাশ কান্তি নাগ বলছেন, জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইনের প্রয়োগ না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি। এতে কৃষিভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের নিরাপত্তার হুমকি প্রকট আকার ধারণ করবে। ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এই জনপদের জীবন-জীবিকা।

আবাসন ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কোন শ্রেণির ভূমি ব্যবহার করা দরকার, সে বিষয়ে ভাববার সময় এসেছে দাবি করে এই কৃষকনেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী বারবার কৃষিজমি অক্ষত রেখে উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে দুই ও তিন ফসলি জমি সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। কৃষিজমি সুরক্ষায় নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা খুবই প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহারে পরিপূর্ণ একটি আইন ও বিধিমালা এখনো প্রণয়ন করা যায়নি। সম্ভবত ভূমি মন্ত্রণালয়ে আটকে রয়েছে একটি আইন। দ্রুত পাস করে আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

রংপুরের একটি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশে কৃষিজমি সুরক্ষার কোনো আইন না থাকায় যে যার মতো কৃষিজমিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। জমির শ্রেণিকরণ না থাকায় চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি ও শিল্পের জমি। জমির সিএস, আরএস বা বিএস-এর কোথাও উল্লেখ নেই যে জমিটি কৃষিজমি নাকি অন্য জমি। জমির ধরনে যেটা উল্লেখ থাকে সেটি হলো নাল, বিল, উঁচু বা কান্দা, বাড়ি ইত্যাদি। জমির সর্বশেষ যে মাঠ পর্চাটি সরকার তৈরি করেছে, যেটি বিএস নামে পরিচিত, সেখানেও জমির উপযোগিতা বিবেচনা করে শ্রেণিকরণ করা হয়নি। এতে একজন কোম্পানির মালিককে কৃষিজমি কেনার ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

রংপুর মেট্রোপলিটন কৃষি কর্মকর্তা আমিনা খাতুন বলেন, ২০১৪ সালে মেট্রোপলিটন কৃষি অফিস শুরুর পর থেকে মেট্রোপলিটন এলাকায় একটি ইটভাটারও লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তিন ফসলি জমি যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য আমরা তৎপর রয়েছি। বর্তমানে কেউ কমিটির অনুমোদন ছাড়া কৃষিজমি অকৃষি খাতে বিক্রি করতে পারবে না।

কীভাবে কৃষিজমি নির্ধারণ করা হয়, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, একই জমিতে তিন মৌসুমে তিনবার চাষাবাদ হলে সেটাকে তিন ফসলি জমি বা কৃষিজমি হিসেবে দেখানো হয়। মূলত কৃষকের ইচ্ছার ওপর অনেক সময় কৃষিজমির ব্যবহার নির্ভর করে। তবে সম্প্রসারিত উন্নয়ন ও নগরায়ণের কাজে প্রতিনিয়ত কৃষিজমির ব্যবহার অকৃষি খাতে বাড়ছে। আর এর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর বেশি দায়ী, সেখান থেকে যদি অনুমোদন দেওয়া হলে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।

এদিকে কৃষি বিভাগ উচ্চ ফলনশীল এবং স্বল্পকালীন ফসল আবাদে গুরুত্ব দেওয়ায় কৃষিজমি কমা সত্ত্বেও জেলায় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ১০ বছরে জেলায় ধান ও গম মোট চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়েছে। গত অর্থবছরে জেলায় শস্যের চাহিদা ছিল ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৩৪ টন। উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৭ হাজার ৮৫৪ টন। তবে কৃষিজমি কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে উৎপাদনে সংকট দেখা দেবে।

অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপপরিচালক মো. মাহবুবর রহমান বলেন, একসময় কৃষিজমি পড়ে ছিল। এখন কিন্তু তা হচ্ছে না, বরং একই জমিতে দুই থেকে তিনবার করে চাষাবাদ হচ্ছে। আমাদের অল্প জমিতে বেশি ফলন ও উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদ করতে হবে। তবেই কৃষিজমির ঘাটতি মোকাবিলা সম্ভব হবে।

রংপুর জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্র বলছে, জেলায় প্রতি মাসে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার জমি কেনাবেচার বিভিন্ন দলিল সম্পাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে কৃষিজমি আছে শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ।

জেলা রেজিস্ট্রার মো. আব্দুস সালাম প্রমাণিক বলেন, প্রতি মাসে গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার জমির দলিল সম্পাদন করা হয়। এতে মাসে গড়ে ১০ কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব আদায় হয়। আমরা শুধু জমি কেনাবেচাসহ বিভিন্ন দলিল সম্পাদন করে থাকি। এ কারণে কেউ কৃষিজমি কিনে অকৃষি কাজে ব্যবহার করবে কি না তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবে আইন করে শুধু কৃষিজমি নয়, যেকোনো জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আগে ভূ-উপগ্রহ চিত্র

গত ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর কার্যালয়ে গিয়ে সেখানকার উপপরিচালক মেজ-বাবুল আলমের কথা বলার চেষ্টা করি। ওই দিন ওই কার্যালয়ে ছিল তার শেষ কর্মদিবস। এ কারণে ভিডিও সাক্ষাৎকার দিতে অপরাগতা জানান। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। বর্তমানে তার কর্মস্থল বগুড়া জেলায়।

উপপরিচালক মেজ-বাবুল আলমের দেওয়া তথ্যমতে, কৃষিজমি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার জেলা প্রশাসক ও ভূমি অফিসের। যেকোনো কৃষিজমিকে অকৃষি বা বাণিজ্যিক, কিংবা শ্রেণি পরিবর্তন করার বিষয়গুলো জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প বা আবাসনের কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করলে সরেজমিন পরিদর্শন করে সেখানকার পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি দেখে তারপর গ্রহণযোগ্য হলে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, কৃষিজমি রক্ষায় সরকারের যে আইন আছে, সেটি অনুসরণ মাধ্যমে আমরা কাজ করছি। কেউ কৃষিজমি কিনে যদি অকৃষি খাতে ব্যবহার করতে চায়, অবশ্যই তাকে অনুমোদন নিতে হবে। তবে তিন ফসলি জমিকে কখনো অকৃষি কাজে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হবে না।

এদিকে সারা দেশে প্রতিবছর মোট আবাদি ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টরের বেশি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এসআরডিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫ বছরে শুধু রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৪৩ হাজার ৯০৫ হেক্টর আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে। দেশে ভূমি অনুযায়ী লোকসংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাড়লেও, কৃষিজমি ১ শতাংশও বাড়ছে না। বরং মোট আয়তনের ১ শতাংশ জমি কমে যাচ্ছে।

কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয়েছিল ২০১১ সালে। সেটা এখনো আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে। সবশেষ কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন-২০১৯-এর প্রাথমিক খসড়ায় আইন লঙ্ঘনের শাস্তি নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বনিম্ন তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। কিন্তু এখনো আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। বর্তমানে কার্যকর ও সময়োপযোগী আইনের অভাবে নির্বিচারে কমে চলছে সোনায় সোহাগা কৃষিজমি।

এনএ