বালিখোলা বাজারে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় কোটি টাকার মাছ
বালিখোলা বাজারে মাছের হাট বসে প্রতিদিন
কিশোরগঞ্জের হাওরের মিঠাপানির মাছের দেশজুড়ে সুখ্যাতি রয়েছে। কিশোরগঞ্জসহ নেত্রকোনা আর সুনামগঞ্জ হাওরের কিছু অংশের মাছ বেচাকেনা হয় কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখোলা মাছ বাজারে। এই বাজারে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হচ্ছে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই কিশোরগঞ্জের ধনু নদের তীরে নৌকা বোঝাই করে মিঠাপানির তরতাজা মাছ নিয়ে বিক্রেতারা আসেন বালিখোলা বাজারে। পাইকারি এ মাছের বাজারে পাওয়া যায় রুই, কাতল, বোয়াল, চিংড়িসহ নানা জাতের মাছ। তবে এখন হাওরে পানি বেশি থাকায় মাছের সরবরাহ কিছুটা কম। তবে দাম অনেকটা চড়া।
বিজ্ঞাপন
প্রায় দেড় শ বছর আগে এ বাজারে মাছ বেচাকেনা শুরু হয়। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম থাকে সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলে পুরোদমে কেনাবেচা। তারপর আড়তদাররা মাছ ট্রাকযোগে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠান।
করিমগঞ্জ উপজেলার ধনু নদের তীরে অবস্থিত এই পাইকারি মাছ বাজারে নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ হাওরের মাছ বিক্রি হয়। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন মাছ কিনতে। প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হয় এখানে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিযোগিতামূলক দরদামে জেলে থেকে শুরু করে ফিশারির মালিকদের কাছ থেকে মাছ কেনে পাইকাররা। এরপর সেগুলো চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
মিঠামইন থেকে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলে হাসান আলী ও অষ্টগ্রাম থেকে আসা কামাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন জেলে জানান, হাওরের মিঠা পানির নানান জাতের মাছ জালে ধরা পড়ছে এবার। ছোট মাছের মধ্যে রয়েছে টেংরা, বাইন, মেনি, টাকি, কাইক্কা, পুঁটি, চিংড়ি ও চাপিলামাছ। বড় মাছের মধ্যে ধরা পড়ছে বোয়াল, কার্প, মৃগেল, বাউশ ও শোলমাছ। এ ছাড়া শিং মাছ ও বিলুপ্তপ্রায় রানিমাছও মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে জালে। তবে ছোট মাছের দাম ও চাহিদা অন্য মাছের চেয়ে একটু বেশি।
এ বাজারে আইড় ৫০০ টাকা, বোয়াল ৪০০, গুলশা ৩৫০, ট্যাংরা ৩৫০, চিংড়ি ৬০০, চিতল মাছ ৫৫০, রুই ৩৫০, কাতলা ৫০০, বাইন ৫০০, পাবদা ৬৫০, কই ৩৫০, মাগুর ৪৫০, শিং ৫০০, শৌল ৪৫০, চাপিলা ২০০, চান্দা ১০০ ও টাকি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা এলাকায় অর্থাৎ হাওরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত বালিখলা মাছ বাজারটিতে টিনের ঘর ছাড়া উন্নত কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। তারপরও হাওরের মিঠাপানির দেশি নানা জাতের মাছের কারণেই বাজারের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল বা সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে বালিখলা মাছ বাজারে সহজেই আসা যায়।
বালিখোলা বাজার মৎস্য আড়ৎ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সালাহ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে জানান, কিশোরগঞ্জসহ তিন জেলার বিভিন্ন হাওর থেকে প্রতিদিন প্রচুর মাছ এ বাজারে আসে। বাজারের অন্তত ৫০টি আড়তে প্রতিদিন অন্তত কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর মাছ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা পাঠাচ্ছেন।
জেলেসহ ব্যবসায়ীরাও মাছের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। আগে ছয় মাস বেচাকেনা হলেও এখন সারা বছর এখানে বেচাকেনা হয়। বালিখলা এ মাছের বাজার থেকে অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তাই ঐতিহ্যবাহী এ মাছ বাজারটি টিকিয়ে রাখতে নদীর পাশ দিয়ে বাজার লাগোয়া সীমানাপ্রাচীরসহ সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।
কিশোরগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল জানান, কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রতিবছর মাছের চাহিদা রয়েছে ৭০ হাজার মেট্রিক টন। আর উৎপাদন হয় ৮২ হাজার মেট্রিক টন। জেলায় মাছের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর প্রায় ২৮ থেকে ৩০ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করা যায়।
তিনি আরও জানান, জেলে ও মাছচাষিদের আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রকল্প শুরু হরা হবে। যাতে মাছ ফ্রিজিং করে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন তারা। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি আধুনিক মৎস্য অবতরণকেন্দ্র হচ্ছে, যা আগামী মাসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলেও জানান তিনি।
মিঠামইন হাওর থেকে মাছ নিয়ে আসা ব্যবসায়ী হাসান আলী বলেন, মিঠামইনের ঘাগড়া নদী আমার সরকার থেকে ডেকে এনে এই মাছ এ বাজারে বিক্রি করি। ভালো দেখে এই বাজারে বিক্রি করি। মছ ইলয়া আজকে চার বছরে ধরে এখানে আসি।
হাওর থেকে মাছ নিয়ে আসা ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, বিল থেকে মাছ আমরা বালিখোলা বাজারে নিয়ে আসি। ভোর ৬টা থেকে আমার মাছ এই বাজারে নিয়ে আসি। আমার মাছ আড়তে দেই। এই বালিখোলা আড়তে অনেক পাইকার আসে। আড়তদাররা পাইকারে মাছ বিক্রি করে। এই বালিখোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে মাছ আমরা বিক্রি করতে পারি। এই জন্য আমার বালিখোলা বাজারে মাছ নিয়ে আসি।
সুনামগঞ্জ হাওর থেকে মাছ নিয়ে আসার ট্রলারশ্রমিক আবুল মিয়া জানান নানা সমস্যার কথা। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার উজানগাঁওয়ের রামপুর বাজার থেকে বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা কান্দে করে মাছ নৌকায় ওঠাই। রাত্রের বেলা নৌকা নিয়ে আমার চামরাঘাটে আসি। সেখানে মাছ দিয়ে আমরা বালিখোলা বাজারে মাছ নিয়ে আসি। এখানে মাছের দাম অনেক। আমার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা রোজ পরে। প্রায় পাঁচ-সাত বছর ধরে আমার নৌকা চালাই। শুধু রাত্রের বেলায় আইতে আমরার টান্ডা-টুন্ডায় কষ্ট হয়। রাতে ডাকাতেও ধরে আমারের। কোনো কোনো বছর সাত-আটবার ডাকাতে ধরে। আমার অনেক ক্ষয়ক্ষতি অয়।
বালিখোলা মাছ বাজারের আড়তমালিক মো. হাফিজ উদ্দিন জানান, আমি একজন আড়তদার মাছ ব্যবসায়ী। এই বালিখোলা মাছ বাজার প্রায় ২০০ বছর ধরে জমে। এই বালিখোলা বাজারে মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনো জেলাসহ অনেক জেলা থেকে মাছ আসে। এই বালিখোল বাজারে অনেক জেলা থেকে মাছ কিনতে আসে। এই বছর আমার মাছ বিক্রি করতে গিয়ে অনেক সমস্যায়। করোনার জন্য মাছ অনেক সস্তায় বিক্রি করতে অয়। আর যার ফিশারি নিয়ে তারাও অনেক লসে আছে। এই বাজারে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যায়।
বালিখোলা বাজার মৎস্য আড়ৎ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সালাহ উদ্দীন বলেন, আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী বালিখোলা বাজার। দীর্ঘ দেড় শ বঝল ধরে এই পুরাতন বাজার। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় ১২টার দিকে শেষ হয়। এই বাজারে অনেক দূরদূরান্ত থেকে মাছ আসে। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোন এবং খালিয়াজুড়ি, ইটনা, মিঠামইনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাদুপানির মাছ আসে। এখানে প্রতিদিন এক কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি হয়। বালিখোলা বাজারে সাশ্রয় মূল্যে নদীর মাছ পাওয়া যায়।
কিশোরগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা একটা মাছের ভান্ডার। এখানে প্রাকৃতিক মাছ ও কালচারাল মাছ এখন অনেক পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে এখন শীত মৌসমে বিল ও হাওরের পানি অনেক কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিক মাছের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। বালিখোল ও ভৈরব মৎস্য আড়তে প্রচুর প্রাকৃতিক মাছ আসছে।
সরকারের মৎস্যবান্ধব গৃহীত প্রদক্ষেপের কারণে আমাদের কিশোরগঞ্জের ১৩টা উপজেরায় ১৪টি মৎস্য অভয়াশ্রম আছে। মিঠামইনে ৪টা, ইটনায় ৩টা, অষ্টগ্রামে ৩টা, তাড়াইলে ২টা, কটিয়াদীতে ১টা ও ভৈরবে ১টা। এ মৎস্য অভয়াশ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিক মাছের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
এনএ