পল্লিচিকিৎসক শেখ মজিবর রহমান ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছেন গরিব অসহায় ব্যক্তিদের

‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’, এ কথার মর্মার্থ পাওয়া যায় নাটোর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে নলডাঙ্গা উপজেলায়। সোনাপাতিল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বারণই নদের কোল ঘেঁষে ছোট একটা মাটির কুঁড়েঘর। অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এটি। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ঘরেই চলছে হাজারো মানুষের চিকিৎসাসেবা। সোনাপাতিল গ্রামের চিকিৎসক শেখ মজিবর রহমান নিজ উদ্যাগে ওই ঘরে গড়ে তোলেন ‘পল্লী জাগরণী মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র’। নিভৃতপল্লির দুস্থ মা ও শিশুর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন জাগিয়েছেন তিনি।

দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে গর্ভবতী মা ও শিশুদের এই কেন্দ্রে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন শেখ মজিবর। শুধু মাটির চেম্বারে নয়, তিনি রাস্তাঘাটে অসুস্থ রোগী দেখলেও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন বিনামূল্যে। এ চিকিৎসা কেন্দ্রে একমাত্র চিকিৎসক শেখ মজিবর রহমান নিজেই।

নলডাঙ্গার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন মজিবর রহমান। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন এমন মানুষ সমাজে বিরল। সেখানে তিনি দরিদ্র মানুষকে সব সময় তার সাধ্যমতো বিনা পয়সায় চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রতিবছর একবার তিনি সহস্রাধিক দরিদ্র ব্যক্তিকে ওষুধসহ ব্যবস্থাপত্র দেন। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পেয়ে খুশি এলাকার মানুষও বেশ খুশি।

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাটোরে নলডাঙ্গা, রাজশাহীর পুঠিয়া, দুর্গাপুর ও নওগাঁর আত্রাই উপজেলার দূরদূরান্ত থেকে আসা কয়েক শ মা ও শিশুর ভিড় হয় গরিবের ডাক্তারখ্যাত ডা. মজিবরের মাটির চেম্বারে। তবে সেই ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে।  বড় বড় ফাটল সৃষ্টি হওয়ায় সেটা এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

মাটির ঘরে বসে চিকিৎসা দেন শেখ মজিবর

জানা যায়, পাঁচ দশক ধরে বিনামূল্যে এই কাজ করে যাচ্ছেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ডা. শেখ মজিবুর রহমান। ১৯৬৭-৬৮ সালে মাধবপুর ও আশপাশের গ্রামগুলোয় গুটিবসন্তে মানুষের মৃত্যু দেখে তিনি পণ করেন, মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। সেই ব্রত নিয়ে রাজশাহীতে রেডক্রস, ইপিআইয়ের প্রশিক্ষণও নেন। সেই থেকে ৫৩ বছর ধরে দিয়ে চলেছেন বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পতিরাম শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধশিবিরে রেডক্রসের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

এ বিষয়ে কথা হয় যশোর থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, আমার সন্তানের ঠান্ডাজনিত সমস্যা ছিল। ওখান থেকে ডাক্তারের খোঁজ পেয়ে এখানে আসছি চিকিৎসা নিতে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা নিতে কোনো ফি লাগে না। তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেন। তিনি আরও বলেন, আমি আগে এখানে আসিনি কিন্তু আমার এক আত্মীয় এখানে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন শুনে এসেছি।

বাসুদেবপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা বিমল চন্দ্র জানান, এর আগে চিকিৎসা নিয়েছি, ভালো হয়েছে। আবার এসেছি কারণ হাতে চুলকানি হয়েছে। এই চিকিৎসক গরিবের বন্ধু। কোনো টাকাপয়সা নেন না। খুব ভালো চিকিৎসা করেন। পল্লিচিকিৎসক হিসেবে অনেক সুনাম রয়েছে তার।

সখিনা বিবি নামের এক সেবাপ্রত্যাশী জানান, চিকিৎসক খুব ভালো। কোনো অসুবিধা নাই। আমরা সব সময় আসি তার কাছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো টাকাপয়সা নেন না। ভালো চিকিৎসা দেন। ১০ বছর ধরে আসি এখানে। এখন আমার মেয়ে গর্ভবতী। তাকে নিয়ে এসেছি। ভালো চিকিৎসা দেন। যে ওষুধ লেখেন, সেই ওষুধে ভালো হয়ে যায় অসুখ।

এ বিষয়ে পল্লিচিকিৎসক শেখ মজিবর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এখানে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু ১৯৬৮ সালেই বেশি। তখন এলাকাতে প্রচুর গুটিবসন্ত ও কলেরার প্রাদুর্ভাব ছিল। আমি তখন রাজশাহীতে পড়াশোনা করতাম। এখান থেকে খবর গেল ১২টা লোক এক রাতে মারা গেছে কলেরায়। কোনো সরকারি চিকিৎসক ভয়ে সেখানে আসেননি। পরে আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ওষুধপথ্য নিয়ে এলাম এবং সারা রাত ভ্যাকসিন দিলাম। তারপর সকালে আরও দুজন মারা গেল। পরে তাদের জানানোর পরে রাজশাহী থেকে টিম এল। আসার পরও কন্ট্রোল হয় না। অনেক পরে কন্ট্রোল হলো। এখানে কোনো সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। চিকিৎসক নাটোর থেকে আসেন। যোগাযোগমাধ্যমও ছিল না। সে অবস্থা থেকে আমাকে শুরু করতে হলো।

রোগীদের ভিড় লেগে থাকে সব সময়

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকায় প্রচুর ডায়রিয়া হয়। ঘরে ঘরে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। সে সময় ডায়রিয়া পুরো ক্যাম্পটাই আমি এখান থেকে সার্ভিস দিয়েছি। পরে ১৯৭৯ সালে প্রথম যখন বাংলাদেশে ইউনিসেফ ইপিআই প্রোগ্রাম অর্থাৎ টিকাদান কর্মসূচি অপ্ল্যাই করে, তখন এ দেশের প্রেসিডেন্ট নিলেন পরে আমি একাই নিয়েছিলাম। নেওয়ার পরে ইপিআই ক্যাম্প এখনো আছে। ইপিআই সরকার ১৯৮৬ সালে সরকারিভাবে নেওয়ার পরে সারা দেশে কার্যক্রম চালু হয়।

তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলেন, সরকার ভালো কাজে ভালো কিছু করে কি না, আমার জানা নাই। আমার বেলায় তো কিছুই ঘটেনি। আজ পর্যন্ত আমি সরকারি এক পয়সা অনুদানও পাইনি। দরখাস্ত দিয়েছি ইউএনওর কাছে, ডিসির কাছে; পৌরসভায়ও দিয়েছি। তবু কোনো সাড়াশব্দ পাইনি।

এখন এখানে একটা টেকসই ভালো আবাসন। যে একটা অসুস্থ রোগী এল, তাকে কোথায় শোয়াব? সে তো জায়গা পায় না। একটা ইনজেকসন পুশ করতে হবে কিংবা একটা স্যালাইন লাগাতে হবে। এখন আমার এখানে বসার ও শোয়ার জায়গা নাই। কোথায় স্যালাইন দেব? আর গ্রামে যেতে যেতে তো তার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। এখানে প্রসবব্যথা নিয়ে কেউ এলেও প্রসব করানোর জায়গা নাই। ভ্যানের ওপরের করতে হয়।

চিকিৎসা দিতে গেলে বেড দরকার, ভালো রুমও দরকার। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি যেগুলো আছে, যেগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। এখানে বেশি রোগী আসতে বসার জয়গাও নেই। ভাঙা বেঞ্চ ছাড়া তো আমার কিছু নেই।

পল্লিচিকিৎসক শেখ মজিবর রহমান

নলডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) সাহেব আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’, এমন কথা আজ সত্য। সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষের হৃদয়ে মায়া-মমতা, বিচার-বিবেক, জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি না করত, তবে এসব কথা ইতিহাসের পাতায় আসত না। আর এ মূল্যবান কথাটির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় চিকিৎসক শেখ মজিবর রহমানের জীবন আদর্শে।

মানুষের সেবার জন্য ঘরসংসার করেননি । চিরকুমার এ মানুষটি গরিব ও দুস্থ মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎস্বর্গ করেছেন।
সেবা করতে গিয়ে শেখ মজিবর নিজের সুখ-শান্তির কথা ভাবেননি। ব্যক্তিগতভাবে তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তবে ‘গরিবের ডাক্তারে’র জরাজীর্ণ চেম্বারটি সংস্কার ও নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নলডাঙ্গা উপজেলায় মজিবর রহমান যেসব সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছেন, সেগুলো আমাদের নলডাঙ্গার অনেক মানুষই উপকৃত হচ্ছেন। তিনি চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন বিনামূল্যে। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশের জন্য যে কাজ করে যাচ্ছেন, এর প্রভাব আমাদের সমাজে পড়ছে। এসব মানুষের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলেই আমাদের সমাজটা আরও সুন্দর হচ্ছে। এতে নলডাঙ্গাবাসী আরও এগিয়ে যাচ্ছে। তার এ কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক, এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাকে সহযোগিতা করব।
 
এনএ