‘হামার এমপি (টিপু মুনশি) সাইব মন্ত্রী হইছে। কিন্তুক হামার এই নড়বড়ে (ঝুঁকিপূর্ণ) সেতুর কোনো পরিবর্তন হয় নাই। সেতুর দুই পাশে বাঁশের সাঁকো দিয়্যা চলাচল করা নাগে (লাগে)। প্রত্যেক বছর বান (বন্যা) হইলে হামার কষ্ট হয়। পাঁচ বছর ধরি এই অবস্থা। এমপি-মন্ত্রী, চেয়ারম্যান-ইউএনও সগায় এই সেতুর কথা জানে।’ 

ক্ষোভ আর হতাশা থেকে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক জহুরুল হক। তার মতো হাজারো মানুষের চোখে-মুখে একই আক্ষেপ। সড়ক বিচ্ছিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর সংস্কার চেয়ে কেউ মুখ খুলছেন আবার কেউ নীরবেই সহ্য করছেন। 

বাইসাইকেলের পেছনে খড়কুটো নিয়ে সাঁকো পার হচ্ছিলেন জহুরুল হক। তার মতো আশপাশের অন্তত ১০ গ্রামের মানুষ সড়কবিচ্ছিন্ন এই সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত করেন। 

দুর্ভোগ আর দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কৃষক জহুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুই পাশে বাঁশের সাঁকো আর মদ্যোতে (মাঝখানে) পাকা সেতু। বছর পাঁচেক আগে বানের সময় সেতুর দুই পাশের আস্তা (রাস্তা) ভাঙ্গি গেইছে। তখন থাকি আর কোনো কাম (সংস্কার) হয় নাই। এমপি তো কিছুই করে না। এ্যলা আস্তা পারাপার হইতে বাঁশের সাঁকো আর নড়বড়া সেতুই হামার ভরসা।’

ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতুর অবস্থান রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায়। সেখানকার বালাপাড়া ইউনিয়নের গোপিডাঙ্গা মৌলভীবাজার গ্রামে গেলে চোখে পড়বে সেতুটি। বর্তমানে এই সেতুর একপাশ হেলে গিয়ে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এলাকাবাসী সেতুর দুই পাশে বাঁশের সাঁকো তৈরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন।

জানা গেছে, ইউএসএআইডি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগিতায় এলজিইডি রংপুরের বাস্তবায়নে ৩৭ লাখ ২৪ হাজার ১৮৩ টাকা ব্যয়ে পাকা সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৪ সালের জুন মাসে সেতুটির উদ্বোধন করেন কাউনিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম মায়া। সেতুটি নির্মাণের ফলে এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনসহ যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হয়। কিন্তু দুই বছর পার না হতেই আঘাত হানে বন্যা। তিস্তার পানির তোড়ে সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়ক ভেঙে যায়। 

দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও সেতুর সংযোগ সড়ক মেরামত না করায় পথচারীরা পড়েন বিপাকে। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। তখন উপায়হীন মানুষরা নৌকায় চলাচল শুরু করে। বর্তমানে স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে সেতুর দুই পাড়ে বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিলেও সেটিরও এখন বেহাল অবস্থা। তারপরও ঝুঁকি নিয়েই চরাঞ্চলের ১০ গ্রামের মানুষ প্রতিদিন সাঁকো আর সেতু ধরে গন্তব্যে যাতায়াত করছেন।  

স্থানীয় মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সেতুর দুই পাশের মাটি সরে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও জনপ্রতিনিধিরা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। সাঁকো দিয়ে আর কত দিন চলতে হবে? দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কয়েক মাস আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন আর সেতু নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।’

স্কুলপড়ুয়া নাবিল ইসলাম জানায়, সেতুর দুই দিকের রাস্তা ভেঙে চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও কেউ আমাদের চরের মানুষের খবর রাখে না। শত শত শিক্ষার্থী এর ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। যদি সাঁকো ভেঙে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, এর দায় কে নেবে? গ্রামের সবার দাবি, এটা সংস্কার করা হোক।

কৃষক আলিম মিয়া জানায়, দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও সেতুটির সংযোগ সড়ক জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসন থেকে মেরামত করেনি। বাধ্য হয়ে এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগে পাকা সেতুর সঙ্গে বাাঁশের সাঁকো তৈরি করেছে। এখন সেই সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছে। 

বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনছার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর মাটি কেটে ভরাট করেছি। কিন্তু বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। নড়বড়ে পাকা সেতুটি ভেঙে ফেলা উচিত। এখন এটাও ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন সেতু নির্মাণর জন্য চারবার আবেদন করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। 

উপজেলা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান জেমি জানান, সেতুটি নতুন করে নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা তারিন বলেন, আমি ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটির ব্যাপারে মন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়ে রাখব। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি