ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে সাতক্ষীরার দেবহাটায় চলছে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প ও মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণ। ভূমিহীনদের চাষের ধান মাটিচাপা দিয়ে চলছে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মাটি ভরাটকাজ। একপক্ষের জন্য বিষয়টি মানবিক ও সুখকর হলেও অন্যদিকে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সেখানকার ৩০ ভূমিহীন পরিবার।

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বলছেন, বিষয়টি খুব অমানবিক। তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোগসাজশ করে ওই জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পটি পাস করিয়েছেন। অথচ অন্য স্থানে হাজার হাজার বিঘা পতিত জমি ছিল, সেখানেই প্রকল্পটি করা যেত।

তবে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলছেন, আইনগত প্রক্রিয়া মেনেই মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে।

ভূমিহীনদের মধ্যে একজন বালিথা গ্রামের বৃদ্ধ আবুল বিশ্বাসের মেয়ে মনোয়ারা বেগম। স্বামী নেই শারীরিক প্রতিবন্ধী এই নারীর। একটি হাত না থাকায় একসময় ভিক্ষাবৃত্তি করলেও ভূমিহীন জনপদে থেকে এক টুকরো জমিতে ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। তাই ছেড়ে দিয়েছিলেন ভিক্ষাবৃত্তি। তবে এখন তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার এখানে ৩০ শতক জমি রয়েছে। ডিসিআর মূলে রয়েছে। এরপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করেছি। জমির মধ্যে এক পাশে আমার ঘর, অন্য পাশে ছিল একটু কৃষিজমি। যেখানে ধান চাষ করতাম। আমার লাগানো ধান মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে। স্যারকে এত করে জানালাম স্যার আমার কিছু নেই, আমার জমিটুকু নেবেন না কিন্তু কথা শুনল না। বলল, ওর জায়গা আগে নাও, এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। পরে ঘটনাটি উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের নিকট দরখাস্ত দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

১৯৮৯ সালে মরিচ্চাপ নদীর চরভরাটি জমিতে বসবাস শুরু করে ভূমিহীন ৩১ পরিবার। তিনটি দাগের ১০ একর (৩০ বিঘা) জমি নিয়ে বসতি গড়েন তারা। প্রতি পরিবার জমি পায় ৩০ শতক। ভূমিহীনদের আশ্রয় দিতে ১৯৯৫ সালে এই পরিবারগুলোকে ডিসিআর দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। এরপর থেকেই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে পরিবারগুলো। ২০১৯ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার পরিকল্পনা করে সরকার।

সরকারি নির্দেশনায় স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার লক্ষ্যে ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেবহাটা উপজেলা কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা বন্দোবস্ত কমিটির সিদ্ধান্তমতে, ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কাছে কেস নথি পাঠানো হয়। বন্দোবস্ত অনুমোদনের জন্য ১১টি ভূমিহীন নথি পাঠান তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাজিয়া আফরিন। ওই বছরের ৭ আগস্ট একইভাবে আরও ১৫টি কেস নথি জেলা প্রশাসকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠান ওই কর্মকর্তা।

মোট ২৬টি ভূমিহীন পরিবারের বন্দোবস্তের অনুমোদনের জন্য যে নথিগুলো জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল, সেই নথিগুলোর মধ্যে ২০টি পরিবার বসবাস করেন বালিথা গ্রামের ওই চরভরাটি জমিতে। যেখানে মুজিব বর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এদিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ওই বন্দোবস্ত তালিকাও এখনো রয়েছে অনুমোদনের অপেক্ষায়।

ভূমিহীন জনপদের বাসিন্দা মৃত জহুর আলী গাজীর ছেলে জি এম আব্দুল মজিদ বলেন, ৩২ বছর ধরে আমরা এখানে বসবাস করছি। প্রথম দিকে ৩১ পরিবার থাকলেও এখন পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। পরিবার বড় হওয়ায় কেউ কেউ আলাদা হয়েছেন। মাত্র ৩০ শতক জমির মধ্যে এক টুকরো ঘর আর কিছুটা কৃষিজমি। যেখানে ধান চাষসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করি আমরা। তবে এখন আমাদের উচ্ছেদ করে দিচ্ছে। আমরাও ভূমিহীন। অথচ আমাদের উচ্ছেদ করে অন্য ভূমিহীনদের ঘর তৈরি করে দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, যেভাবে ধানখেতে মাটিচাপা দিয়েছে, এতে কান্নার রোল পড়েছে প্রতিটি পরিবারে। একশ্রেণির মানুষ বিশেষ সুবিধা নিয়ে আমাদের উচ্ছেদ করতে এই জায়গাটি নির্ধারণ করেছে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজে। গায়ের জোর খাটিয়ে এটি করছে। আমরা ভয়ে কিছু বলতেও পারছি না। কেউ ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। আমাদের উচ্ছেদের আগে কোনো নোটিশও প্রদান করা হয়নি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাচ্ছি, ইউনিয়নের মধ্যে অনেক পতিত জমি রয়েছে, সেখানে এই প্রকল্পের কাজটি করা হোক। আমাদের এভাবে উচ্ছেদ করলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? সবাই আবারও রাস্তায় নেমে যাবে।

ভূমিহীন আব্দুল মজিদের মতো একই দাবি করেন অসহায় ভূমিহীন পরিবারগুলো। তবে রূপচান শেখের ছেলে ভূমিহীন দাবি করা রফিকুল ইসলামের আলীশান বাড়ি। দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাসাদ। বর্তমানে ভূমিহীনদের ধানের জমি ভরাটের মাটি ফেলার দায়িত্ব পালন করছেন রফিকুল। প্রথমে নিজেকে এই কাজের ঠিকাদার পরিচয় দিলেও পাল্টা প্রশ্নে ভোল পাল্টে বলেন, ইউপি সদস্য জাহিদুর রহমান জুয়েল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন এটি ভরাট করতে, তাই করছি। টাকাও দেয় ইউপি সদস্য। ভূমিহীন অসহায় হলে প্রাসাদ গড়লেন কীভাবে, এমন প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি।

পরে তার বিষয়ে জি এম আব্দুল মজিদ বলেন, মাটি ভরাট করে টাকা নিচ্ছেন রফিকুল। দূর থেকে ট্রলিতে মাটি এনে ফেলা হচ্ছে কৃষিজমিতে। ধান গাছগুলো চাপা পড়ছে মাটির নিচে। নির্বাচনে ইউপি সদস্য জাহিদুর রহমান জুয়েলকে ভোট না দেওয়ায় তিনি আমাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহিদুর রহমান জুয়েল বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাকে এই মাটি ভরাটের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে কারণে ভরাট করছি। এখন পর্যন্ত মাটি ভরাটকাজে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছি। ভরাটকাজের জন্য ৮৭ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কয়টি ঘর হবে, কতটুকু জমি ভরাট হবে, সেই ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলতে পারবেন। আমি নামে মাত্র প্রকল্পের মাটি ভরাটকাজের সভাপতি।

দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চরবালিথা গ্রামে মুজিব বর্ষের গৃহনির্মাণ প্রকল্পে জন্য তিন একর জায়গা নেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রকল্পের আওতায় ৮০টির অধিক ঘর নির্মাণ করা হবে।

কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদুল হক বলেন, পরিকল্পিতভাবে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে ওই জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছে। সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আসাদুল ইসলাম ও সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাছলিমা আক্তার যোগসাযোশ করে জায়গা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সেটি পাস হয়ে সেখানেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউনিয়নের মধ্যে হাজার হাজার বিঘা পতিত জমি পড়ে ছিল, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেত। সেখানে প্রকল্পের কাজটি করা হচ্ছে ওই জায়গাটিতে ভূমিহীন পরিবারগুলো চাষাবাদ করে সংসার চালাত। এখন সেটি বন্ধ হয়ে গেল।

তিনি আরও বলেন, মূলত এই ভূমিহীন পরিবারগুলো আমার সমর্থক। সে কারণে তাদের উচ্ছেদ করতে পরিকল্পিতভাবে কাজটি করা হয়েছে। সরকার যখন যেকোনো জমি নিতে পারে। তবে অন্য জায়গায় কাজটি করা যেত।

প্রকল্প বিষয়ে জানতে চাইলে দেবহাটা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শফিউল বাশার কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। প্রকল্পের যেকোনো বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, জমিটি বিলান জমি। বিভিন্ন মানুষ চাষ করে খেত। নিয়ম মেনে নোটিশ করে জায়গাটি ছেড়ে দিতে বলা হলে তখন তারা জায়গাটি ছেড়ে দিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুজিব বর্ষের গৃহনির্মাণ করে দেওয়ার জন্য সেখানে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সেখানে যেসব মানুষ চাষ করে খেত, তাদের মধ্যে যদি কেউ ভূমিহীন বা গৃহহীন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে গৃহনির্মাণ করে দেওয়া হবে বলে নিশ্চয়তা দেন এই কর্মকর্তা।

এনএ