শ্রীপুর উপজেলাজুড়েই নুরজাহান বেগমের ধাত্রী হিসেবে সুনাম রয়েছে। কারও প্রসবের যন্ত্রণার খবর পেলে, ডাক পড়তেই পেছনে না তাকিয়ে রওনা দেন তিনি। প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি ধাত্রীর কাজ করে বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। এক হাতে তিনি দুই হাজারের বেশি স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছেন।

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চন্নাপাড়া গ্রামের দুই সন্তান আতাব উদ্দিন (৫৭) ও শাহাব উদ্দিনকে (৫০) নিয়ে বসবাস করেন নুরজাহান বেগম (৮৭)। সোমবার (৭ মার্চ) বিকেলে শ্রীপুর পৌরসভার চন্নাপাড়া গ্রামে কথা হয় নুরজাহান ওরফে বাউজির সঙ্গে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় স্বামী আবুল হোসেনকে হারান নুরজাহান। এ সময় দুই সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। প্রতিবেশী মামিশাশুড়ি ধাত্রীর কাজ করতেন। পরে তাকে ধাত্রীর কাজ শেখানোর অনুরোধ করেন। তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে এরপর আর থেমে থাকেননি।

নুরজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এ কাজে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দিন আর রাত নেই, মানুষ সব সময় আমার কাছে আসে এবং ডেকে নিয়ে যায়। কোনো প্রসূতির আত্মীয়স্বজন আমাকে ডেকে পাননি, এমনটা কেউ বলতে পারবেন না। ঝড়-বৃষ্টির-রাত উপেক্ষা করে আমি এই সেবাটি করেছি। এই কাজটি করে আমি মনে প্রশান্তি পাই।

তিনি বলেন, ধাত্রীর কাজ করতে গিয়ে আমি কখনো টাকার চাহিদা করিনি, আমি চেয়ে কখনো কিছু আনিনি। আমাকে খুশি হয়ে যে যা পেরেছে তা-ই দিয়েছেন। আমি কখনো মন খারাপ করিনি। অনেক সময় টাকা ছাড়াও আমাকে আসতে হয়েছে, আবার অনেকে ১০০ টাকা দিয়েও বিদায় করেছে। এতে আমার বিন্দু পরিমাণ কষ্ট অনুভব হয়নি।

টাকার চেয়ে সামাজিক দায়িত্বটা অনেক বড়, এমনটা মনে করে তিনি বলেন, আমি এ কাজের জন্য প্রথমে খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতাম। একসময় তিনটি খাতা ভরে গিয়েছিল, পরে আর আমি প্রসবের তথ্য খাতায় লিপিবদ্ধ করিনি। তবে এ পর্যন্ত দুই হাজারের ওপরে স্বাভাবিক প্রসবে কাজ করেছি। এ কাজের জন্য সরকারিভাবে কোনো প্রশিক্ষণ না পেলেও আশাসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

বড় ছেলে আতাব উদ্দিন বলেন, মায়ের (নুরজাহান) কাছে ধাত্রীর কাজটি অনেকটা নেশার হতো হয়েছে। যেখানেই তার ডাক পড়ে, পাগলের মতো ছুটে যান। আমরাও মায়ের এ কাজটিতে সহযোগিতা করি, উৎসাহ দিই। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মা ছুটে যান।

চন্নাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, জীবনযুদ্ধে বাউজি খালা এক সফল যোদ্ধা। তার হাতে অনেকেরই সন্তানের জন্ম হয়েছে। প্রসব জটিলতায় তার ডাক পড়ে দূরদূরান্ত থেকে। তাকে পারিশ্রমিক হিসেবে যা দেওয়া হয়, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন।

স্থানীয় বাসিন্দা কামাল হোসেন ১৯ বছর আগে তার একটি ঘটনার স্মৃতিচারণা করে বলেন, আমার স্ত্রীর স্বাভাবিক ডেলিভারি হবে জানিয়েছিলেন স্থানীয় এক ধাত্রী। যথাসময়ে সময়ে এক রাতে আমার স্ত্রীর প্রসববেদনা ওঠে। ওই ধাত্রী অনেক চেষ্টা করেও ডেলিভারি সম্পন্ন করতে পারছিলেন না। আমার স্ত্রী ও অনাগত সন্তান মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল। ওই রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতিও ছিল না আমাদের। শেষ রাতের দিকে আমি বাউজি বুবুর কাছে ছুটে যাই। তিনি আসার কিছু সময় পর আমার ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। এখন আমার ছেলে বয়স ১৯ বছর। ওই দিন রাতে বাউজি বুবু খবর পাওয়ার সাথে সাথে না আসলে আমার ছেলে ও স্ত্রীকে বাঁচানো কষ্ট হয়ে যেত।

শ্রীপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হাবিবুল্লাহ্ বলেন, ধাত্রী-দাই হিসেবে বাউজির সুনাম রয়েছে। সরকারিভাবে বাউজির জন্য একটি বয়স্ক ভাতা কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি যদি আরও কোনো সহযোগিতা চান, তাহলে তার ব্যবস্থা করা হবে।

শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রণয় ভূষণ দাস বলেন, গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ নারীর প্রসব হয় ধাত্রীর সহায়তায়। এক হাতে দুই হাজারের বেশি নরমাল প্রসব করানো সত্যিই প্রশংসার। সরকারিভাবে তিনি যদি প্রশিক্ষণ করতে চান তাহলে ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

এনএ