শান্ত নদীর স্বচ্ছ পানি আর সুস্বাদু দেশীয় মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল শীতলক্ষ্যা। গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া উপজেলাকে বিভক্ত করেছে নদীটি। নদীপাড়ের মানুষরা একসময় নদীকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করতেন, রান্নাসহ ঘরের কাজে নদীর পানিই ব্যবহার করতেন। আর এখন নদীকেন্দ্রিক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু পাল্টে নদীটি তার জৌলুস হারিয়েছে। বর্তমানে পানি ব্যবহার তো দূরের কথা, দুর্গন্ধে আশপাশে থাকা দায়।

কাপাসিয়ার সিংহশ্রী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার পারভেজ বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছের উৎসের যোগান দিত নদীটি। কৃষি অর্থনীতির চালিকা শক্তিও এ নদী। কয়েক বছর ধরে নদীর দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নদীর পানি কালো হয়ে গেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাছ ধরাসহ নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা চালানো অনেকেই এখন পেশা পরিবর্তন করে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনেই আমাদের ঐতিহ্যের ধারক শীতলক্ষ্যার মৃত্যু দেখতে হচ্ছে। 

জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে গাজীপুরের উত্তর সীমান্তের জেলা ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য সেখানকার খিরু নদীর মাধ্যমে প্রবেশ করছে শীতলক্ষ্যায়। বর্ষার পর যখন প্রবাহমান পানির ধারা থেমে যায় তখনই নদীটি পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। নদীকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা জলজপ্রাণীগুলোও আর তখন টিকতে পারে না। 

নদী গবেষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশের উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ময়মনসিংহ জেলার একটি নদী খিরু। ডাকাতিয়া নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া এ নদীটি ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শ্রীপুরের সোনাব এলাকায় সুতিয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। পরে সুতিয়া শ্রীপুরের কাওরাইদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নান্দিয়াসাঙ্গুন ত্রিমোহনী এলাকায় শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ভালুকা শিল্পাঞ্চলের দূষিত পানি দীর্ঘ দিন ধরেই খিরু নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে শ্রীপুরের মধ্য দিয়ে শীতলক্ষ্যায় প্রবেশ করছে। বর্ষায় নদীর স্রোত থাকায় দূষণের তেমন কোনো প্রভাব না থাকলেও বর্ষা চলে গেলে বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে পড়ে নদীর পানি। এতে জলচর প্রাণীর জীবন সংকটে পড়ে।

দুই বছর ধরে শীতলক্ষ্যায় নানা জীববৈচিত্র্য বিষাক্ত পানিতে টিকতে না পেরে মারা যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও কার্যত কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি। প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও শিল্প বর্জ্যের হুমকিতে রয়েছে জলজপ্রাণী। দূষণ বন্ধে স্থানীয়রা নানা ধরনের আন্দোলন করলে ফল মেলেনি।

কাওরাইদ এলাকার নুরুল হুদা মোড়ল বলেন, খিরুর দূষণে আমাদের সুতিয়া নদীও পড়েছে। নদীকেন্দ্রিক কৃষি অর্থনীতি এখন অনেকটা থমকে গেছে। চোখের সামনেই প্রতিনিয়তই নদীর গুরুত্ব কমতে দেখছি। দূষণের কারণে নদীতে এখন মাছও মেলে না। এখন মানুষের নজর নদীর দখলের দিকে।

নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, শিল্পকারখানা কর্তৃক দূষণের কারণেই বর্তমানে শীতলক্ষ্যার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। বর্ষাকালে দূষণের উৎসগুলো বের করা না গেলেও পরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রশাসন এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতি বছরই শীতলক্ষ্যার জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। বর্ষা থেমে গেলে নদীর প্রবাহমান ধারাও বন্ধ হয়ে যায়, নদীর তলদেশে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেইসঙ্গে শিল্পকারখানার নানা ধরনের বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে নদীর ভেতরের পরিবেশ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। তখন প্রাণীর জীবন ও জীবিকার সংকট তৈরি হয়। একটি নদী আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন ব্যাপক অবদান রাখে তেমনি নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যও আমাদের নানাভাবে সহায়তা করে।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা বাঁচাতে আমরা দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে আজও শীতলক্ষ্যার দূষণ বন্ধ হচ্ছে না। গত বছর যদি প্রশাসন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিত, তাহলে এবার আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। শীতলক্ষ্যার পানি এখন বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। শিল্পবর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানির কারণে এখন দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, শীতলক্ষ্যা দূষণের বিভিন্ন উৎসস্থল চিহ্নিত করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। সীমিত জনবল দিয়ে আমাদের কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এর পরও আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই দূষণ বন্ধ করতে পারব। 

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান বলেন, নদীদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করা হবে। সেইসঙ্গে কলকারখানাকেও শতভাগ ইটিপি ব্যবহারে নজরদারির আওতায় আনার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। নদীদূষণ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

শিহাব খান/এসপি