এবার সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের সময় কমেছে
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। এবার সুন্দরবনের গাছে-গাছে আগেই ফুল ধরেছে। ফলে ১৮৮৬ সাল থেকে চলতে থাকা সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের মৌসুমে পরিবর্তন এনেছে বন বিভাগ। ১ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ মার্চ থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের মৌসুম। ১৫ দিন আগে মধু সংগ্রহের মৌসুম শুরু হলেও আগে মেয়াদকাল ৩০ জুনের পরিবর্তে ৩১ মে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে তিন মাসের জায়গায় দুই মাস ১৫ দিন মধু সংগ্রহের সময় পাবেন মৌয়ালরা।
পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে আহরণ করা মধুর অধিকাংশই সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছিল ১৪১৯ দশমিক ৫০ কুইন্টাল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছিল ২০০৬ দশমিক ৬০ কুইন্টাল। ২০২০-২১ অর্থবছরে মধু সংগ্রহ হয়েছিল ২১৫৯ দশমিক ১৫ কুইন্টাল।
বিজ্ঞাপন
সবশেষ ২০২১ সালের মধু ও মোম আহরণের জন্য এক হাজার ১২টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। এই অনুমতিপত্রের বিপরীতে ৬ হাজার ৭৯৭ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে গিয়েছিলেন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পূর্বের মৌয়ালরাই মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবন যাবেন।
বিজ্ঞাপন
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের কর্মকর্তা এম এ হাসান বলেন, সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম ছিল পহেলা এপ্রিল থেকে ৩০ জুন। মৌয়ালদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের মৌসুম ১৫ দিন পেছানো হয়েছে। এখন ১৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম নির্ধারণ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এতে মৌয়ালরা দুই মাস ১৫ দিন সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। পহেলা জুন থেকে ৩০ আগস্ট তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তখন কাউকেই বনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, ৩-৪ বছর ধরে মৌয়ালরা এই প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। প্রস্তাবটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষদের লিখিতভাবে জানানো হয়। অবশেষে তাদের সেই প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে এবং সেটি চলতি মৌসুমেই কার্যকর হচ্ছে।
মৌয়ালদের অভিযোগ ছিল, সুন্দরবনে এখন খলিশা, গরান, বাইন এসব গাছে ফুল আসে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধুও আগে ভাগেই সংগ্রহ করে চাকে জমা করে। তবে এই সময়ে সুন্দরবনে থাকা কাকড়া ধরা জেলেরা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে নেয়। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয় মৌয়ালরা। সে কারণে ১৫ দিন পরে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন তারা।
চলতি মৌসুমে কতজন মৌয়াল সুন্দরবনে মধু সংগ্রহে যাবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সুন্দরবন অঞ্চলে সাধারণত একজনই বিভিন্ন কাজে প্রবেশ করেন। মূলত যিনি মাছ, কাকড়া ধরতে যান তিনিই আবার মধু সংগ্রহ করতে সুন্দরবনে যান। সে কারণে গত বছর ৬ হাজার ৭৯৭ জন মৌয়াল বনে গিয়েছিলেন। এ বছরও ওই পরিমাণ মৌয়ালই সুন্দরবনে যাবেন।
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনীমুখা গ্রামের মৌয়াল শহিদুল ইসলাম গাজী। তিনি জানান, আমি প্রতি বছরই সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য যাই। সুন্দরবনে এখন খলিশা, গরান, বাইন, হরকাচা, সুন্দরী, গিবো, কেওড়া, পশুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ফুল ফুটেছে। সে কারণে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে ভরাট করে মৌমাছি। মধু সংগ্রহের জন্য ১৫ দিন আগে বন বিভাগ অনুমতি দেয়।
একই এলাকার মৌয়াল আজিজুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে সবার আগে ফোটে খলিশা ফুল। এই ফুলের মধু সব থেকে দামি ও জনপ্রিয়। এরপর গরান, কেওড়া ও বাইন গাছের ফুল ফোটে। তারপর পর্যায়ক্রমে সব গাছে ফুল আসে। এসব ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করি আমরা। ১৫ দিন আগে পাস পাওয়ায় এবার কাকড়া ধরতে গিয়ে জেলেরা মধু কাটতে পারবে না। তবে আগে তিন মাস মধু সংগ্রহ করতে পারতাম, এখন ১৫ দিন কমিয়ে দিয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আমাদের চারপাশে। সেটি এখন আমরা উপলদ্ধি করতে পারি। যেমন এবার শীতের মৌসুমটা ছিল বৈচিত্র্যময়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের গাছ, পরিবেশেও প্রভাব ফেলেছে। এখন সুন্দরবনের খলিশা ফুল আগে ভাগেই ফুটছে। ফলে মধুও আগে পাওয়া যাচ্ছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনে গাছের বৈচিত্র্যে পরিবর্তন এনেছে। মৌয়ালদের দাবি ছিল, মধু সংগ্রহের মৌসুমটি এগিয়ে আনার। সবদিক বিবেচনা করে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের মৌসুম ১৫ দিন এগিয়ে ১৫ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এসপি