রাশিয়ার হামলায় নিহত ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে নোঙর করে রাখা বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। হাদিসুরের সহপাঠী ও স্থানীয়দের দাবি, হাদিসুরের মৃত্যুর পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরের অবহেলা ছিল।

যুদ্ধ শুরুর পর দ্রুত পদক্ষেপ নিলে প্রকৌশলী হাদিসুর হয়তো বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের বাকি ২৮ জনের মতোই জীবিত অবস্থায় মায়ের কোলে ফিরতে পারতেন। মঙ্গলবার গ্রামের মাটিতে হাদিসুরের দাফন শেষে ঢাকা পোস্টের কাছে আক্ষেপ করে এসব কথা বলেন স্বজন, সহপাঠী ও স্থানীয়রা। 

তবে বাংলাদেশ অভ্যান্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ, শিপিং করপোরেশন এবং মেরিন একাডেমির দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেছেন, সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না বলেই দুর্ঘটনার পরে হলেও অতিদ্রুত সময়ে নিহত হাদিসুরের লাশ বাড়িতে পৌঁছানো হয়েছে।

নিহত হাদিসুরের মা আমেনা বেগম বলেন, যেভাবে জাহাজের অন্যদের উদ্ধার করে দেশে নিয়ে আসা হয়েছে সেভাবে যদি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই জাহাজ ফেরত নিয়ে আসা হতো তাহলে আমার হাদিসুর লাশ হয়ে ফিরত না। অন্যদের মতো জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারত। 

তিনি বলেন, হাদিসুরই পরিবারের একমাত্র আয়ের মানুষ ছিল। এখন তো সে নেই। সংসার চলবে কেমনে? সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার যে দুজন সন্তান আছে তারা যেন লেখাপড়াটা ভালোভাবে করতে পারে। আমার মেজ ছেলেকে যেন একটি কর্মস্থান করে দেয়, তাহলে আমার সংসারটি চলতে পারবে।

হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স বলেন, আমার ভাই নিহত হওয়ার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় জাহাজের বাকি ২৮ নাবিককে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে দেশে ফেরানো হয়েছে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা যদি আগে করত তাহলে আমার ভাইকে আজ লাশ হয়ে ফিরতে হতো না। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের কি অক্ষমতা আছে জানা নেই, কেন তারা আমার ভাইয়ের মৃত্যুর আগে প্রচেষ্টা চালায়নি?

হাদিসুরের চাচাত ভাই আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চেষ্টার অভাব ছিল শিপিং করপোরেশনের। হাদিসুরের মৃত্যুর পর তাদের হুঁশ হয়েছে। এই হুঁশ যদি আগে ফিরত তাহলে আমার ভাইকে হারাতে হতো না।

বেতাগী পৌরসভা জামে মসজিদের খতিব ক্বারি মোহাম্মদ বশির উদ্দিন বলেন, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হয়েছে তাতো সারাবিশ্ব জেনেছে। এই জানাজানি হওয়ার পরপরই যদি সরকার ওই দেশে বাঙালি উদ্ধারে প্রক্রিয়া শুরু করত তাহলে হয়তো হাদিসুরকেও জীবিত ফেরানো যেত বলে আমরা মনে করি।

হাদিসুরের সহপাঠি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও তৌহিদুর রহমান হিমেল বলেন, বাংলাদেশ সরকার তার চেষ্টার মাধ্যমে যুদ্ধ চলমান একটি রাষ্ট্র থেকে ২৮ জন নাবিককে জীবিত ও হাদিসুরের লাশ দেশে ফেরাতে পেরেছে। আমি মনে করি এই প্রচেষ্টা যদি আগে করত তখন হয়তো হাদিসুরের এমন পরিণতি হতো না। 

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন আবু সুফিয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোঙর করে রাখা জাহাজে যে হামলা হবে সেটি ধারণার বাইরে ছিল। হামলার পরে মূলত আমাদের জাহাজটি অনিরাপদ হয়ে যায়। সরকার কিন্তু জীবিত ২৮ যে নাবিক দেশে ফিরল তাদের যেমন মূল্যায়ন করেছে তেমনি হাদিসুরের মরদেহও মূল্যায়ন করেছে।

তিনি বলেন, শিপিং করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী আগামী এক মাসের মধ্যে হাদিসুরের পরিবারকে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। মনে রাখতে হবে এ ক্ষতিপূরণ কারো দয়া নয়, এটি হাদিসুরের প্রাপ্য।

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, বরিশালের কমান্ডেন্ট ক্যাপ্টেন এসএম আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের হয়ে কাজ করার জন্যই তিনি ওই জাহাজে ইউক্রেনে গিয়েছিলেন। এ দুর্ঘটনার পর আমরা সরকারের পক্ষ হয়েই এখানে এসেছি। পরিবারকে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই ভবিষ্যতে তারা যেন একাকীবোধ না করে। আমরা সবসময়ে তাদের পাশে রয়েছি।

তিনি বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য থেকে যেভাবে সকলকে সরকার উদ্ধার করে নিয়েছে এটি অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন প্রচেষ্টা ছিল। সেখানে দক্ষতার সঙ্গে সফল হয়েছে।

উদ্ধারের প্রশ্নে বলেন, আটকেপড়া জাহাজের নাবিকদের উদ্ধারে সকলের আন্তরিকতা ছিল। অনেকে অনেক রকমভাবে বলতে পারেন। আমি বলব সরকারে আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের ক্যাপ্টেন আলী রেজা বলেন, ব্যাপারটি আসলে ওরকম না। যুদ্ধকালীন রাষ্ট্র থেকে কাউকে আনতে গেলে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে যেতে হয়। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজটি যখন সেখানে নোঙর করে তখনো সেখানে যুদ্ধপরিস্থিতি ছিল না। ওই বন্দরে এখনো অনেক অনেক জাহাজ নোঙর করা আছে। বাংলাদেশের ছিল মাত্র একটি। যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাহাজের সকল নাবিককে দ্রুত সময়ে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।

প্রসঙ্গত, গত ২ মার্চ রাতে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকেপড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধিতে রকেট হামলা চালায় রুশ সেনারা। এ হামলায় জাহাজের প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফ নিহত হন। পর দিন ৩ মার্চ সন্ধ্যায় অক্ষত ২৮ নাবিক এবং হাদিসুরের মরদেহ ইউক্রেনের একটি বাংকারে নেওয়া হয়। সেখানে হাদিসুরের মরদেহ রেখে বাকি নাবিকদের নিরাপদে রোমানিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। 

গত ৯ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে তারা দেশে ফিরেছেন। সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ১৪ মার্চ দেশে ফেরে হাদিসুরের মরদেহ। ওই দিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে বরগুনার বেতাগীতে অ্যাম্বুলেন্সযোগে মরদেহ পৌঁছে। সকাল ১০টায় জানাজা শেষে মরদেহ দাফন করা হয়। 

নিহত প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফ বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের রাজ্জাক হাওলাদারের ছেলে।

এমএএস