চলাচলের সক্ষমতা হারিয়েছেন ১৫ বছর আগে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছেন। কিন্তু দুই বছর হলো শরীরে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধে কেউ কাছে আসতে চায় না। আত্মীয়-স্বজনও খোঁজ নেয় না। মারা যাওয়ার আগে যেন চিকিৎসা করাতে পারেন সেই আকুতি জানিয়েছেন হুমায়ূন কবির। 

হুমায়ূন কবির বরিশাল জেলার গৌরনদী পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড বড় কসবা পূর্বপাড়ের সরদার বাড়ির নাজের সরদারের বড় ছেলে। থাকেন ছোট ভাই জলিল সরদারের ঘরের বারান্দায়।

হুমায়ূন জানান, বিয়ের এক মাস পরের কথা। বাড়ির সামনে একটি খেজুর কাছের রস নামাতে উঠেছিলেন। সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। পরিবারের সামর্থ্য না থাকায় উন্নত চিকিৎসা হয়নি। ফলে দিন দিন চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েন। অক্ষম অবস্থায় ছোট একটি দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। স্ত্রী শাহেদা বেগম কোলে-পিঠে করে সেবা-শুশ্রুষা করেছেন। তাদের দুই ছেলের মধ্যে একজনের বয়স ১৮ এবং অন্যজনের ১৪ বছর।

এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন হুমায়ূন। তিনি বলেন, গত বছরের (২০২১) শেষ দিকে কোমরের নিচের অংশে ফোঁড়া ওঠে। সেই ফোঁড়া থেকে বিভিন্ন দিকে নালা হয়ে পচন ধরতে থাকে। এরপর আমার দোকান বন্ধ হয়ে যায়। পরে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। তখন ডাক্তার বলেন, বসে থাকতে থাকতে পশ্চাৎদেশে পচন ধরেছে। তারা আমাকে ঢাকার ক্যানসার হাসপাতালে রেফার করে। কিন্তু আমার তো নিজের সংসার চালানোরই টাকা নেই। চিকিৎসা চালাব কেমনে?

মাঝে মাঝে পরিবারের চারজনকেই না খেয়ে দিন পার করতে হয় উল্লেখ করে বলেন, আমার সংসারে এখন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমার ছেলে। সে গৌরনদীর একটি চক্ষু হাসপাতালে মাইকিং করে মাসে চার হাজার টাকা মাইনে পায়। আর তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যতটুকু পায় তা দিয়ে সংসার চলে।

শরীরে পচন ধরার পর তিন ভাই ও ছয় বোনের কেউ এক পলক দেখার জন্যও আসেনি। এমনকি বরিশাল হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর বাড়ি এসে ছোট ভাইও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

অসহায় হুমায়ূন বলেন, বিপদে স্ত্রী ও সন্তান ছাড়া আমার পাশে আর কেউ নেই। আমার দাবি একটু চিকিৎসা পেয়ে মারা যেতে চাই। চিকিৎসার সহয়তার জন্য গৌরনদী উপজেলা সমাজসেবা অফিসে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসে বরাদ্দের সব টাকা বিতরণ হয়ে গেছে। এখন কাউকে সাহায্য করার মতো বরাদ্দ নেই। স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে সাহায্যের জন্য জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো সহায়তা করেননি। কাউন্সিলরকে মোবাইল করে জানিয়েছিলাম, একবার দেখতেও আসেননি।

‘ডাক্তার বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য দুই লাখ টাকার বেশি লাগবে। যে স্থানে পচন ধরেছে সেখানের মাংস কেটে ফেলে দিয়ে চিকিৎসা করালে সুস্থ করা সম্ভব। গত বছরের নভেম্বর মাসে আমাকে ঢাকা রেফার করেছে। কিন্তু টাকার অভাবে আজ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যেতে পারিনি। বাড়িতে এনে রেখেছে আমাকে।’

হুমায়ুন বলেন, এক দিন সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কিন্তু আমি যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যাই সেই ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চাই। প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাকে একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিন।

হুমায়ূন কবিরের স্ত্রী শাহেদা বেগম বলেন, ছেলে চার হাজার টাকা আয় করে। সেই টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে। এক বেলা খাই, দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়।

তিনি আরও বলেন, তাকে আর কোনো ওষুধ না খাওয়াতে পারলেও নিয়মিত গ্যাস আর ব্যথার ওষুধ খাওয়ানো লাগে। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু ডাক্তার যে টাকার কথা বলেন তা আমাদের কাছে নেই। ফলে ঘরে এনে ফেলে রেখেছি। কি করবো বলেন? মানুষকে মারা যেতে হয়। কিন্তু ছোট-বড় সকলের কাছে অনুরোধ, আমার স্বামী যেন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ না করেন, সেই ব্যবস্থা একটু করে দেন।

প্রতিবেশী চাচাতো ভাই আল-আমিন বলেন, হুমায়ূন কবির দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। দুই বছর হলো তার শরীরে পচন ধরেছে। কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। আমাদের বংশের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করাতে পারবে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গৌরনদী ব্লাড ডোনার ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান রমজান বলেন, অসুস্থ হুমায়ূন কবিরকে আমরা বিভিন্ন সময়ে সাধ্যমতো সহায়তা করেছি। কিন্তু তার শরীরে পচন ধরার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য যে টাকার প্রয়োজন তা আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব না। আমি সকলকে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি। বিশেষ করে সরকারের কাছে অনুরোধ করতে চাই, হুমায়ূন কবিরের শেষ ইচ্ছা যেন পূরণ করা হয়।

বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, হুমায়ূন কবির সর্ম্পকে আমাকে আগে কেউ জানায়নি। আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। সমাজসেবা অধিদপ্তর বিগত দিনেও অসহায়দের সহায়তা করে এসেছে। তেমনি হুমায়ূন কবিরকে সহায়তা করা হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এসপি