ভরসার নাম ‘আঁচল’
আলিয়া আফরিন রিতু। বয়স হয়েছিল ১ বছর ৩ মাস। পুরোদিন বাড়ি মাতিয়ে রাখত সে। কিন্তু গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পানিতে ডুবে মারা যায়। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার এক পর্যায়ে গুমরে কেঁদে উঠেন মা ফারজানা। তার কান্নায় উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।
শেরপুর জেলা সদর থেকে ১২-১৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েই কামারিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রাম। এই গ্রামেই স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন গৃহিণী ফারজানা।
বিজ্ঞাপন
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফারজানা বলেন, ‘বাচ্চাটারে ভাসুরের মাইয়্যার কাছে রাইখ্যা সেদিন আমি বাড়ির বাইরে কাজে গিয়েছিলাম। কাজ শেষ কইরা আইসা দেহি আমার মাইয়্যা কোথাও নাই। এদিক-সেদিক খুঁইজা কোথাও মাইয়াডার খোঁজ পাইতেছিলাম না। পরে বাড়ির পাশে একটি নালা থাইক্যা ভাসমান অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করি। আমার মাইয়্যাডা আটতে আটতে (হাঁটতে হাঁটতে) পানিতে পইরা গেছিল। কেউ তারে দেহে নাই। আমি সতর্ক থাকলে এইডা হইত না। অহন গেরামে আঁচল মা আছে। তারা গেরামের বেবাক পুলাপানগো দেহাশোনা করে। এহন তাদের বাপ, মায়েরা নিশ্চিন্ত মনে গৃহস্থলির কাজ সারতে পারে।’
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআরবি পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের মধ্যে ৩০ জনই পাঁচ বছরের কম বয়সী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৩ লাখ ৫৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর ৯০ শতাংশই মারা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। আর বাংলাদেশে ১-৪ বছরের শিশুর মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশই মারা যায় পানিতে ডুবে।
তাই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। সিআইপিআরবি কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ চার ঘণ্টা (সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা) পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখা ও শিক্ষামূলক নানা কাজে অন্তর্ভুক্ত করার কর্মসূচির নাম ‘আঁচল’।
সিআইপিআরবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবির) সম্মিলিত গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে ‘আঁচল’ কর্মসূচি হাতে নেয়। পরবর্তী কয়েক বছরে ৩ হাজার ২০০ কেন্দ্র বাড়ানো হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় শেরপুর সদর উপজেলার কামারিয়া, ভাতশালা, লছমনপুর, চরমোচারিয়া, চরপক্ষিমারী, পাকুরিয়াসহ সাত ইউনিয়নে পরিচালিত হচ্ছে ‘আঁচল’ কেন্দ্র।
শেরপুর সদরের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের তালেবুল ইসলামের বাড়িতে রয়েছে একটি আঁচল কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের আঁচল মায়ের নাম ইফানা আক্তার (৩৬)। তার সহকারীর নাম শাপলা খাতুন (২৫)।
ইফানা আক্তার বলেন, আমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন আঁচল মা। আমার একজন সহকারী আছে। তার নাম শাপলা খাতুন। আমার আঁচল কেন্দ্রে ২২ জন শিশু রয়েছে। সকাল ৮-৯টার মধ্যে সহকারী শাপলা গ্রামের সব বাড়ি থেকে শিশুদের আঁচল কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। আমরা দুজনে মিলে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৯ থেকে ৫৯ মাসের শিশুদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করি। এছাড়া শিশুদের আমরা ছড়াগানসহ প্রারম্ভিক বিকাশ ঘটাতে নানা কাজ করি। যদি কোনো বাচ্চা না আসে, তবে আমার সহকারী বা আমি তাদের বাড়ি গিয়ে আনার চেষ্টা করি এবং খোঁজ-খবর নিই।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এই সেন্টারটি চলছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পানিতে ডুবে যে শিশুটি মারা গেছে, করোনার কারণে সে সময় ‘আঁচল’ কেন্দ্রটি বন্ধ ছিল। আঁচল হওয়ার আগে এই গ্রামে বছরে দু-চারজন শিশু মারা যেত। এখন সেই হার অনেক কমেছে।
সরেজমিনে আঁচল কেন্দ্রে দেখা গেছে, টিনশেডের একটি ঘর। মাটির মেঝেতে বিছানো রয়েছে শীতল পাটি। সুন্দর করে সাজানো ঘরটি। ঘরের চার কোনায় ঝুলছে রঙিন কাগজের ফুল। দেয়ালে ব্যঞ্জন ও স্বরবর্ণ লেখা। এছাড়া রয়েছে সংখ্যা, মাছ, পাখি, প্রাণী, ফলের ছবিসহ বাচ্চাদের আঁকা বিভিন্ন ছবি।
রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রাম থেকে হেঁটে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। গ্রামের নাম হাজীপাড়া। সেখানে ইজ্জত সরদারের বাড়ির সামনে রয়েছে আরেকটি আঁচল কেন্দ্র। সেখানে যাওয়ার পথে কিছুটা দূর থেকেই কানে ভেসে আসছিল শিশুদের কোলাহল। এই কেন্দ্রের আঁচল মা নিপা। কোমলমতি শিশুদের নিয়ে আড্ডায় ব্যস্ত তিনি। নিপার সঙ্গে অভিনয় করে ছড়া বলছে উপস্থিত শিশুরা।
এই গ্রামের গৃহিণী জুলেখা বেগম বলেন, বাচ্চাটারে আঁচলে রাইখা আমার ম্যালা সুবিধা হইছে। এখন আমি সংসারের সব কাজ করবার পারি। গরু-বাছুর মাঠে চড়াতে নিতে পারি। বাচ্চাটা এহানে রাখলে আমার কোনো চিন্তা অয় না।
পাশের বাড়ির গৃহিণী নূরজাহান বলেন, ‘আমার তিনডা সন্তান। ছোট দুইডারে আঁচলে রাইখ্যা নিশ্চিন্তে কাজ করি। সেখানে গিয়ে ল্যাহাপড়াও শিখে, নিরাপদেও থাহে। গেরামে আঁচল থাকাতে আমাগোর অনেক উপকার হইছে।
এই গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, আঁচল মা পোলাপানগো দেখাশোনা করে। ওখানে আদর ও নিরাপদে থাহে। ডোবা, খালে, বিলে পানিতে যাইতে পারে না। তাই পানিতে পইরা শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কম।
শেরপুর সদরের কামারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আব্দুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আঁচল’ থাকায় গ্রামের দরিদ্র মানুষের অনেক উপকার হয়েছে। মায়েরা যখন কাজ করে তখন তাদের বাচ্চাদের আঁচলে রাখা হয়। এতে বাচ্চারা নিরাপদে থাকে।
এই ইউপি সদস্য আরও বলেন, বর্ষার সময় সব জায়গায় পানি থাকে। এই কেন্দ্রটি হওয়ার পর বাচ্চাদের পানিতে পড়ার ঝুঁকি কমে গেছে। মা-বাবা আঁচলে তাদের বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্ত মনে পরিবারের অন্যান্য কাজকর্ম করতে পারেন।
সিআইপিআরবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আল-আমিন ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুটি প্রকল্পের অধীনে এখন দেশের ছয়টি জেলায় ৩ হাজার ২০০টি আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে শিশুর সংখ্যা ৫৬ হাজার। পটুয়াখালী, বরগুনা, চাঁদপুর, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ ও শেরপুর জেলায় আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৯ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ২০- ২৫ জন করে শিশু রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন প্রশিক্ষিত আঁচল মা ও একজন সহকারী থাকেন। আঁচল মা ও সহকারীকে পাঁচ দিনের একটি ইনক্লুসিভ ট্রেনিং দেওয়া হয়। একটি প্রকল্পে আঁচল মা তিন হাজার টাকা ও সহকারী এক হাজার টাকা এবং অন্য প্রকল্পে আঁচল মা দুই হাজার ২০০ টাকা ও সহকারী ৭৫০ টাকা পান। আঁচল মাকে কমপক্ষে দশম শ্রেণি ও সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানতে হয়। পরিবারের অন্য সদস্যরা যে সময়টা কাজে ব্যস্ত থাকে অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সেসময় শিশুরা আঁচল কেন্দ্রে অবস্থান করে। তাই শিশুর পানির কাছে যাওয়া ও মৃত্যু ঝুঁকি অনেটাই কমে যায়।
শেরপুর সদর উপজেলা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের ৫টি উপজেলায় ৫৩২টি আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। গত ২০২০ ও ২০২১ সালে সাত উপজেলায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ১২ জন শিশু পানিতে ডুবে এবং অন্যান্য কারণে মারা গেছে। বর্তমানে আঁচলের কারণে এসব এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমষ্টির গবেষণা ও যোগাযোগ পরিচালক মো.রেজাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার সবচাইতে বেশি। কারণ এই সময়ে শিশুর মা-বাবা গৃহস্থলির কাজে ব্যস্ত থাকে। সিআইপিআরবি কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ চার ঘণ্টা পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখা ও শিক্ষামূলক নানা কাজে অন্তর্ভুক্ত করার কর্মসূচির নাম ‘আঁচল’। এটি নিয়েও আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। দেশের যেসব উপজেলা/ইউনিয়নে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশি সেসব এলাকায় যেন বাধ্যতামূলক ‘আঁচল’ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শেরপুর সদর উপজেলা সিআইপিআরবি কার্যালয়ের সমন্বয়ক মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেখানে আঁচল সেন্টার রয়েছে সেখানে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। একইসঙ্গে সেখানকার মা-বাবাও অনেক সচেতন হয়ে গেছেন। শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা দেওয়া হয়। তাই তাদের ভীতিটা আর থাকে না। তাই অন্য যেকোনো শিশুর চেয়ে আঁচলের শিশু বেশি অ্যাডভান্স।
জাহিদুল খান সৌরভ/এসপি