মানিকগঞ্জে শিক্ষক নিহত
শিক্ষক সহকর্মীরা তাদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেননি
‘আমার বোনরে আইনা দেন, আমার জোড়া ছুইটা গেল রে, আমারে থুইয়া গেল কে। ও ভাইরে, আমার বোন তো কথা বলে না রে।’ বোনের মরদেহের পাশে এভাবেই বিলাপ করছিলেন নিহত স্কুলশিক্ষক ফাতেমা নাসরিনের বোন ইয়াসমিন আক্তার।
সোমবার (২১ মার্চ) দুপুরে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ভালকা গ্রামে নিহত স্কুলশিক্ষক ফাতেমা নাসরিনের বাড়িতে চলছে স্বজনদের শোকের মাতম। বোনের মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন ইয়াসমিন। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাকে জড়িয়ে বিলাপ করেন নিহতের ভাই আসলামও।
বিজ্ঞাপন
এদিকে মায়ের নিথর মরদেহের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ফাতেমার মেয়ে অহনা আক্তার। মাকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে স্তব্ধ সে। ফাতেমার ছেলে নাহিদেরও একই অবস্থা।
নিহত ফাতেমার ভাই আসলাম উদ্দিন বলেন, আমার বোনকে তো আর ফিরে পাব না। বোনের এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে, এখন তাদের কী হবে? তারা তো মাকে হারাল। আমার বোন ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে শিক্ষকতা করে আসছে। একটি প্রতিষ্ঠানের ভতর কীভাবে গাড়ি থাকে, আর সেই গাড়ি বের করতে গিয়ে গাড়ির ব্রেক ফেল হয়ে স্কুলে ছাত্রী ও শিক্ষক মারা যায়, এ প্রশ্ন রেখে ঘটনার সুষ্ঠ বিচার দাবি করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
চর চারিপাড়া গ্রামের রিকশাচালক রফিক বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ গাড়ি রাখার জন্য স্কুলে ভেতরের জায়গা ভাড়া দিয়েছিল। স্কুল খোলার পরে অভিভাবকরা গাড়ি সরিয়ে ফেলার জন্য বললে একটি গাড়ি সরিয়ে ফেলে। স্কুলের জায়গাটা পার্কিংয়ের জন্য ভাড়া না দিলে আজ এই দুর্ঘটনা ঘটত না। আর দুইজন মানুষের প্রাণ হারাইত না। এই দুইজনের প্রাণ গেল, এর দায়ভার কে নিবে? আমরার এর সঠিক বিচার চাই।
আব্দুল আলিম মেমোরিয়াল স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী রনি হোসেন বলেন, করোনার সময় স্কুলে স্যার শহিদুর রহমান গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেন। স্কুল খোলার পরে আমরা স্যারকে বলছিলাম, স্যার, গাড়ি পার্কিং বন্ধ করে দেন। কেননা এখানে ছোট বাচ্চারা লেখাপড়া করে, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু স্যার আমাদের কথার কোনো পাত্তা না করে গাড়ি পার্কিং দিছে। স্যার যদি আমাদের কথা শুনত, তাহলে আজকে আমাদের ম্যাডাম ও শিক্ষার্থীকে হারাতে হতো না।
উলাইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফলতির কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনার পর স্কুলের কোনো শিক্ষক সহকর্মীরা তাদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেননি। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
এ ঘটনার পর আব্দুল আলিম মেমোরিয়াল স্কুলের মালিক পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া অন্য শিক্ষরাও গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা যায়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই কোম্পানির একটি গাড়ি ভাড়া দিয়ে স্কুলের মাঠে রাখা হতো। সকালে শিক্ষার্থীরা খাবারের বিরতির সময় মাঠে আসে। এ সময় গাড়ির চালক গাড়িটি চালু করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়।
এ সময় ঘটনাস্থলেই শিক্ষার্থী তাসনিম মারা যায়। আহত হন শিক্ষক ফাতেমাসহ ৫-৭ জন। পরে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিক্ষক ফাতেমার মৃত্যু হয়। ঘটনার পর স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকরা পালিয়ে যান। পিকআপচালককে আটক করেছে এলাকাবাসী।
শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহিন বলেন, ধারণা করা হচ্ছে চালক অনগিয়ারে বা বাতাস স্পেস না করেই স্টার্ট দিয়েছিল। ফলে গাড়িটি দ্রুত সামনের দিকে রান করে এবং স্কুলের ভেতরে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এ ঘটনায় গাড়িটি আটক করা হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ, সোমবার (২১ মার্চ) সকাল পৌনে ১১টার দিকে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার টেপড়া এলাকায় আব্দুল আলিম মেমোরিয়াল স্কুলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতে স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিবালয় উপজেলার টেপড়া গ্রামের সহিদুল ইসলামের মেয়ে জারিন তাসনিম (৭) ও বিদ্যালয়ের শিক্ষক উপজেলার ভাকলা গ্রামের আওলাদ হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা নাসরিনের (৩৫) মৃত্যু হয়।
সোহেল হোসেন/এনএ