‘সেদিন আমার চোখের সামনে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কপালে গুলি লাগে। তার মাথা থেকে মগজ ছিটকে পানিতে পড়ে। আমি পানি থেকে তার দেহ ওপরে তুলি। সেই স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়। সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে এখনো আমার রাতে ঘুম হয় না।’ এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন ১ নং সেক্টরের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭ নং প্লাটুন কমান্ডার বীর বিক্রম মো. আবুল হাসেম (অবসরপ্রাপ্ত)। 

তিনি বলেন, সেদিন শ্রীমঙ্গলের ধলই বর্ডার আউটপোস্টের নালায় আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করছিলাম। তারা আমাদের অবস্থান বুঝতে পেরে ওপর থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করে। আমরা নিচের দিকে থাকায় ঠিকমতো গুলি করতে পারছিলাম না।  হামিদুরসহ আমি নালার ডান দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছিলাম। তখন পাকিস্তানি বাহিনী মেশিন গান দিয়ে গুলি শুরু করে।

আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। তখন ছিল রমজান মাস। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সেদিন রোজা ছিলেন। আমিও সেদিন রোজা রেখেছিলাম। প্রায় ৩৩ কিমি দূরে গিয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। ওই যুদ্ধে আমরা শেষ পর্যন্ত ধলই বর্ডার আউটপোস্টটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

বীর বিক্রম অনারারী ক্যাপ্টেন মো. আবুল হাসেম (অবসরপ্রাপ্ত) নোয়াখালী সদর উপজেলার ৩ নং নোয়ান্নই ইউনিয়নের শালেপুর গ্রামের মৃত আবদুল জব্বারের ছেলে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।  

রণাঙ্গনে যাওয়ার অনুপ্রেরণা

১৯৬২ সালে কোরআন শপথ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেই। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেই যাচ্ছেন। যশোর ক্যান্টনমেন্টে দেখতাম আমার ধর্মীয় বোনদের নিয়ে নির্যাতন করছে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা। সেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মুক্তির সংগ্রামে মাঠে নেমেছি।

যুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ বপন করেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অসংখ্য নিরস্ত্র বাঙালির প্রাণ দিতে হয়েছিল সে রাতে। ২৯ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে মাসলিয়া বিপি নামক স্থানে একত্রিত হই। যদি দেশ না থাকে, মা-বোনের সম্মানই না থাকে, তবে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কী? দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেদিন। আমার সংকল্প ছিল যদি বাঁচতে হয়, তবে স্বাধীন দেশেই বাঁচব।

রোমহর্ষক স্মৃতিচারণ

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাটি আমার যুদ্ধকালীন সব থেকে ভয়ঙ্কর স্মৃতি। হামিদুর অবিবাহিত ছিলেন। তার কথা মনে পড়লে আজও আমি কান্না করি। আজ রাতে ঘুমাতে পারব না। হামিদ সুঠাম দেহের মানুষ ছিলেন।  আমাদের ক্যাম্পে ভাত রান্না করতেন। আমাকে বলেছিল, যুদ্ধ করতে এখানে এসেছে, ভাত রান্না করতে নয়। যদি বাঁচি তাহলে যুদ্ধ করে বাঁচব, মরলে যুদ্ধ করে মরব। যুদ্ধে হামিদুরের মাথার খুলি উড়ে যায়। পানিতে তার মগজ তুলার মতো ভাসছিল। আমি পানি থেকে তার দেহটি তুলি। এ স্মৃতি আমার মনে এখনও দাগ কেটে আছে।

সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ

যশোরের বেনাপোল, নাভারণ, জামালপুর জেলার কামালপুরসহ বৃহত্তর সিলেট জেলার বিভিন্ন জায়গায় মোট ৯টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের সবগুলো যুদ্ধই সফল হয়েছে। নভেম্বরের শেষ দিকে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত আটগ্রাম সেতু আক্রমণ ও দখল করি। ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। সেখান থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করি।  ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের কানাইঘাট যুদ্ধে আমি আহত হই। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য উত্তর ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের লখনৌ যাই। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা দেই।

৪৬ বছর পর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাই

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর শত্রুর পুতে রাখা মাইন নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে আহত হয়ে ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। দীর্ঘদিন ধরে এক চোখে পৃথিবী দেখেছি। ২০১৬ সালে সামরিক হাসপাতালে চোখের অপারেশন হয়। অপারেশন শেষে দুই দিন পর ডাক্তার আমার চোখের ব্যান্ডেজ খোলেন। ৪৬ বছর পর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দ কখনো বলে বোঝাতে পারব না।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে পরামর্শ

আমরা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। নতুন প্রজন্মের মূল কাজ হবে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা এবং দেশের প্রয়োজনে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। আগামীর সুন্দর পৃথিবীর জন্য সকলকে সুন্দরভাবে চলতে হবে। শিক্ষিত হয়ে দেশের জন্য সেবা করতে হবে।

জীবনের শেষ চাওয়া

কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। একটা সময় মুক্তিযোদ্ধারা মারা যাবেন। তখন জাতির অনেকেই ভুলে যাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আমার নামে বড় মসজিদ-ইসলামগঞ্জ সড়কের নামকরণের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নামকরণটি এখনও হয়নি। বেঁচে থাকতে যদি নামকরণ করা হতো তাহলে শান্তিতে মরতে পারতাম। কিছু মানুষ এই নামকরণ দেখেই মনে করবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

সদর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিলন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নামকরণের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের কাছে যাচ্ছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। আজ না কাল এমন করে বছরের পর বছর গেল কিন্তু নামকরণ আর হলো না। জীবদ্দশায় নামকরণ হলে তিনি দেখে যেতে পারবেন। যদি তাও না হয় তাহলে আমাদের কিছু বলার নাই। 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন। আমি এ জেলায় এসেছি অল্প কিছু দিন হয়েছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এসপি