দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইপিআরে চাকরিকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন দুই বার পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন এই বীর মক্তিযোদ্ধা। সহযোদ্ধা ও পরিবার জানত আব্দুল মান্নান মারা মারা গেছেন। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা আর নির্ভিক সাহসিকতার কারণে তাকে মারতে পারেনি পাক-বাহিনী। 

ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নান একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করে অসংখ্যা পাক সৈন্যকে হত্যা করে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তারই স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৭২ সালে মেজর জেনারেল আতিকুর রহমান তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করেন। সনদপত্র প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  

বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান ১৯৪৭ সালের ৪ অক্টোবর নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি বসবাস করেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মমিনপাড়া এলাকায়। ১৯৬৭ সালে তিনি ইপিআরে যোগ দেন। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইপিআরে চাকরির সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তিনি তেঁতুলিয়ায় বাস করছিলেন। যুদ্ধ থেকে দেশে ফিরে তেঁতুলিয়াতেই বিয়ে করেন তিনি। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

 
মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল মান্নানের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। এখন তার বয়স ৭৫ বছর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়লে এখনো তার  শরীরের লোম কাটা দিয়ে ওঠে। কখনো কখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সহযোদ্ধাদের হারানোর করুণ দৃশ্য। বীর প্রতীক আব্দুল মান্নানের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছে নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট। 

আব্দুল মান্নান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ইপিআরে (বর্তমান বিজিবি) যোগদান করেন। ইপিআর দিনাজপুর সেক্টরের আওতায় ঠাকুরগাঁও উইংয়ের পঞ্চগড় কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ছিল তার কর্মস্থল। পঞ্চগড় শহরের করতোয়া সেতুর কাছে ছিল ইপিআরের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার। সেখানে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাঠান দাবিলদার মোগলবাজকে পঞ্চগড়ের চোপড়ামারী ক্যাম্পে বদলি করা হয়। 

চোপড়ামারী ক্যাম্পে পাঠান, পাঞ্জাবি ও বিহারি ছিল ৪ জন এবং বাঙালিও ছিল ৪ জন। আব্দুল মান্নান নিয়মিত রেডিওতে খবর শুনতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে ক্যাম্পে বসে খবর শুনছিলেন। এ সময় হাবিলদার মোগলবাজ চড়াও হন তা ওপর। আব্দুল মান্নানকে খবর শুনতে বাধা প্রদান করেন হাবিলদার মোগলবাজ। এ ঘটনায় দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে হঠাৎ হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় আব্দুল মান্নানের প্রিয় রেডিওটি। 

মূলত আব্দুল মান্নানের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল কর্মস্থল ইপিআর ক্যাম্পের পাঠান, পাঞ্জাবি ও বিহারি সৈন্যদের গুলি করার মধ্য দিয়ে। পঞ্চগড় ক্যাম্প থেকে ট্রাকে করে তিনি ও তার সহকর্মী চলে যান পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও এবং পরবর্তীতে দিনাজপুরে। আর পাক সৈন্যরা রংপুর ও সৈয়দপুর থাকত। তারা দুটি দলে বিভিক্ত হয়ে একটি ঠাকুরগাঁও ও আরেকটি দিনাজপুর এলাকায় অগ্রসর হওয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল। তারা বাঙালিদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে ও গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছিল। এ সময় পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে মুক্তিযোদ্ধারা। দিনাজপুর কান্তা ফার্মের সামনে মান্নানসহ অনেকেই বাঙ্কার খুঁড়ে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু পাক সৈন্যের সংখ্যা বেশি ও বড় অস্ত্র থাকায় তারা দ্রুত এগিয়ে আসছিল। এ সময় ভয়ে অনেকই পালিয়ে যায়। 

তবে মান্নান বুঝতে পারেন এ সময় পাক বাহিনীকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারলে তারা দ্রুত এগিয়ে যাবে। আব্দুল মান্নান তার দুই সহযোদ্ধা আব্দুর রহমান ও আব্দুস সাত্তারকে পালিয়ে গেলে গুলি করবেন- এই ভয় দেখিয়ে থাকতে বাধ্য করেন। এবার তিনজন মিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর গুলি করা শুরু করেন। এতে অনেকেই নিহত হয়। তবে সন্ধ্যার দিকে কাছে থাকা গুলি শেষ হয়ে যায়। ফলে এই সুযোগে পাক সৈন্যরা আরও এগিয়ে আসে। 

এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে গুলি সংগ্রহের জন্য সাত্তার বাঙ্কার থেকে ওপরে বের হয়ে আসলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সাত্তারের মৃত্যুর পর মান্নান ও রহমানকে আটক করে নিয়ে যায় সৈন্যরা। পরে তাদের হত্যা না করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য  সৈয়দপুর সেনানিবাসে রাখে। সেখানে প্রতিদিন তাদের দুজনকে নির্যাতন করত পাক সৈন্যরা। 

প্রায় এক মাস নির্যাতনের পর তাদের পাঠানো হয় রংপুর সেনানিবাসে। সেখান থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কোনো এক সন্ধ্যায় মান্নান ও রহমানসহ কিছু বাঙালি যুবকদের চোখ-মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর উপশহরের পুকুর পাড়ে। সেখানে তাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করে পর্যায়ক্রমে গুলি করতে থাকে তারা। মান্নানের সঙ্গে থাকা সাত্তারকেও গুলি করে মেরে ফেলে। পরে গুলি করা হয় মান্নানকে। তবে আব্দুল মান্নানের গুলি লাগে ঘাড়ে ও হাতে। ঘাড়ের গুলিটি গলা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। গলা ও বাম হাতের কনুইতে গুলির আঘাতের চিহ্ন এখনও রয়েছে আব্দুল মান্নানের।

গুলি লাগার পর আব্দুল মান্নান লাশের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে যান। এ সময় পানির পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন তিনি। পরে হঠাৎ নামে রহমতের বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টির কয়েক ফোটা পানি তার মুখে পড়ে। এর কিচ্ছুক্ষণ পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। মধ্যরাতে যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখেন সেই লাশের ওপরেই পড়ে আছেন তিনি। পরে আহত অবস্থায় লাশের স্তুপ থেকে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে স্থায়ীয়রা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। 

ওই গ্রামে কয়েক দিন থাকার পর ভারতের তরঙ্গপুর ট্রেনিং সেন্টারে তাকে নেওয়া হয়। পরে আব্দুল মান্নানকে তার সহযোদ্ধারা প্রথমে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। কয়েক জায়গায় চিকিৎসা করিয়ে পরে ভারতের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন এবং বিডিআরে যোগদান করেন। সেখানে কয়েক বছর চাকরি শেষে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। 

যুদ্ধের সময়কার অনেক ছবি তিনি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করেছেন। তার পাওয়া বিভিন্ন ক্রেস্ট, সনদ, সম্মাননা ও স্মৃতি তিনি সংরক্ষণ করেছেন তার বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে। সংরক্ষিত সেসব স্মৃতি দেখতে যান তরুণ প্রজন্ম। 

তবে তিনি জানিয়েছেন তার বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো না। তাই সরকারের কাছে জীবনের শেষ সময়ে তিনি থাকার ঘরের দাবি জানান। পাশাপাশি তার স্মৃতিসমূহ সংরক্ষণ করে রাখার জন্য এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। এ ছাড়া তার বাড়িতে একটি মুক্তিযুদ্ধ কর্নার করার দাবি জানান, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি থাকবে এবং এখান থেকে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে পারবে। 

এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান শুধু তেঁতুলিয়া উপজেলার নয় পুরো জেলার গর্ব। তিনি দুটি দাবির কথা জানিয়েছেন। আমরা তার দাবি দুটি আমলে নিয়ে তার পাশে থাকার চেষ্টা করব।  

আরআই