মেঘনায় তলিয়ে যাওয়ার পথে জনতাবাজার প্রাথমিক স্কুলের দোতলা ভবন

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার চানন্দী ইউনিয়নে মেঘনা নদীতে তলিয়ে যাওয়ার পথে জনতাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনটি। শুধু এটি নয়, তলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে পাশের ফরিদপুর বাজার ও হেমায়েতপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন দুটিও।

ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে আরও অন্তত ১০টি বিদ্যালয় ভবন। ভবনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার পথে হাজারও শিশুশিক্ষার্থীর স্বপ্ন।

স্থানীয়দের মতে, নদীতে বিলীন হয়ে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তেমনি ক্ষতির মুখে এ অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ছাড়া ভবনগুলো ভেঙে নদীতে পড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। তাই সরকারিভাবে নদীভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

আসছে বর্ষার আগে অতি দ্রুত বিদ্যালয়গুলো বাঁচানোর দাবির পাশাপাশি নদী শাসনের মধ্য দিয়ে ব্লক বাঁধ নির্মাণ করে হাতিয়ার এ বিশাল জনপদকে রক্ষার আকুতি ভুক্তভোগীদের।

সরজমিন দেখা গেছে, জনতাবাজার বহুমুখী বিদ্যালয়ের ভবনের দক্ষিণ পাশের নিচের অংশে মাটি সরে গিয়ে মেঘনার বুকে ঢলে পড়েছে। ভবনের দেয়ালের চারপাশে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। বড় অংশ নিয়ে ফাটল ধরে আছে আশপাশের মাটিও। ভবনটি যেকোনো মুহূর্তে মাটিসহ ভেঙে পড়তে পারে নদীতে। এ আশঙ্কায় বিদ্যালয়টির ভেতরে থাকা আসবাবপত্র আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নে নির্মাণ করা হয়েছে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩০টি ভবন। যেগুলো আবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতো। এগুলোর মধ্যে ৭ বছরে চরবাসার, শেখ হাসিনা বাজার, আদর্শ গ্রাম, বাতানখালি, জয়বাজার, মুজিববাজার, রেহানাবাজার, মসজিদ মার্কেট এম আলী, শাবনাজবাজার হাজী গ্রাম ও কিল্লারবাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশ্রয়কেন্দ্র ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

এ ছাড়াও একই সময়ে নদীগর্ভে গেছে প্রায় ১৫টি মসজিদ, ১০টি বাজার, ৩৭টি দাখিল, ইবতেদায়ি ও নূরানি মাদ্রাসা। বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত ২০ হাজার পরিবার। আর এই পরিবারগুলো বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকার সড়কের পাশে বসতি করে রয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জনতাবাজারে নির্মিত হয় জনতাবাজার বহুমুখী আশ্রয়ণকেন্দ্র ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি। প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ডস সরকার ও ইফাদের যৌথ অর্থায়নে চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প-৪ (সিডিএসপি) এর আওতায় দুই তলায় ১০টি কক্ষবিশিষ্ট ভবনটি নির্মাণ করে। মাত্র ৬ বছরে এ ভবনটি এখন নদীগর্ভে বিলীনের পথে।

বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের সময় বিদ্যালয়ের এ ভবনটিতে আশ্রয় নিত হাজার হাজার মানুষ। বাকি সময় এখানে বেসরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান চলত। কিন্তু কয়েক মাস আগে মেঘনার ভাঙনের মুখে পড়ে বিদ্যালয়টি। ভবনটি নদীতে তলিয়ে গেলে এলাকার তিন শতাধিক শিশুশিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন হুমকির মুখে পড়বে। মেঘনায় বিলীনের পথে রয়েছে ফরিদপুর বাজার ও হেমায়েতপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন দুটিও। এ দুই বিদ্যালয়ের ছয় শতাধিক শিশু পড়াশোনা করে।

স্থানীয়রা জানায়, দ্রুত বিদ্যালয়গুলো রক্ষার পাশাপাশি নদীতে ব্লক বাঁধ নির্মাণ করে এ জনপদকে রক্ষা করা জরুরি। এ ছাড়াও ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরিয়ে নিলে নদীতে চলাচলকারী নৌযান বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। একইসঙ্গে সরকারের মালামাল কিছুটা উদ্ধার হবে।

ফরিদপুর বাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাফর ইকবাল বলেন, তার বিদ্যালয়ে মোট চারজন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭৬ জন। করোনাকালীন বন্ধের আগে নিয়মিত চলছিল পাঠদান কার্যক্রম। কিন্তু কয়েক মাসে মেঘনা নদী বিদ্যালয় ভবনটির সন্নিকটে চলে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে নদীতে ভেঙে পড়বে বিদ্যালয়টি।

শিশুশিক্ষার্থী মামুন জানায়, সে জনতাবাজার বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। যখনই মেঘনা নদী বিদ্যালয়টির সন্নিকটে চলে আসে তখন সে তার পরিবারের সঙ্গে চরআজমল গ্রামে চলে যায়। বর্তমানে সে স্থানীয় ভূমিহীন বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হয়েছে। জনতাবাজার বিদ্যালয়ের তার অনেক সহপাঠীই বিদ্যালয়টি ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে।

এদিকে হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ভব রঞ্জন দাস বলেন, জনতাবাজার বহুমুখীসহ যে সব বিদ্যালয়ের ভবন মেঘনার ভাঙনের মুখে রয়েছে সেগুলো থেকে আসবাপত্র সরিয়ে হেফাজতে রাখার জন্য পরিচালনা কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান হোসেন বলেন, ভেঙে পড়া বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি কোনো জায়গাতে অস্থায়ীভাবে বিদ্যালয় করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালানোর ব্যবস্থা করার জন্য পরিচালনা কমিটিকে বলা হয়।

তবে হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মোরশেদ ঢাকা পোস্টকে জানান, আমরা নদীভাঙন রোধে কাজ করছি। একনেকে থাকা বিলটি পাস হলে দ্রুত নদীভাঙন রোধে কাজ শুরু করা হবে।

হাসিব আল আমিন/এমএসআর