• অনাহারে অর্ধাহারে শ্রমিক-কর্মচারী
• বেতন-ভাতাসহ বকেয়া ২২ কোটি টাকা
• ১০ মৌসুমে লোকসান ৫০৫ কোটি টাকা
• ৩৮৯ জনকে অন্য চিনিকলে বদলি
• বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি নষ্টের উপক্রম
• কৃষিনির্ভর শিল্পকারখানার জন্য প্রস্তাব

‘৯ মাস ধরে বেতন নেই। পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে। চিনিকলগুলো বন্ধ না রেখে সরকার একটু নজর দিলেই আমরা বাঁচি। দীর্ঘদিন ধরে চিনিকলে মাড়াই বন্ধ থাকায় আমরা বেতন পাচ্ছি না। এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছি।’

এভাবেই অতিকষ্টে কাটানো দিনাতিপাতের কথাগুলো বলছিলেন শ্যামপুর চিনিকলের অফিস সহায়ক ও এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সদস্য আমিনুল ইসলাম।

সম্প্রতি রংপুর জেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্যামপুর চিনিকল এলাকায় গেলে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সেখানকার কর্মকর্তাসহ শ্রমিক-কর্মচারীদের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, একসময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা চিনিকল এলাকাটিতে এখন সুনসান নীরবতা। দাপ্তরিক কার্যক্রম চললেও নেই আগের সেই ব্যবস্তা। বেশির ভাগ দপ্তরে তালা ঝুলছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিও কম। যারা আছেন, তাদের মুখে নেই হাসি।

চিনিকলের কারখানা বিভাগের জুনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান ও এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সহসভাপতি আব্দুস সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি চিনিকলে মাড়াই বন্ধ রেখেছে। এভাবে আর কত দিন চলবে, এখনো বলা যাচ্ছে না। আমাদের বকেয়া বেতন-ভাতার কোনো সুরাহা হয়নি। সন্তানদের পড়ালেখা, সংসার চালানোসহ নিত্যখরচাপাতি করতে না পেরে আমাদের অবস্থা নিম্ন স্তরে যাচ্ছে।’

শ্যামপুর চিনিকলে কর্মরত আমিনুল-সাত্তারের মতো শত শত শ্রমিক-কর্মচারী চোখে এখন অন্ধকার দেখছেন। চিনিকলের ওপর নির্ভর করে সংসার চালানো এখানকার শ্রমিক-কর্মচারীরা বলছেন, বেতনসহ অন্য খাত মিলে প্রায় ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চিনিকলটিতে বিকল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আট-নয় মাস ধরে বেতনও নেই। এখানকার সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নতুন বিনিয়োগে কৃষিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

অফিস ভবন থেকে বেরিয়ে কারখানার প্রধান ফটক পেরিয়েও চোখে পড়ে একই চিত্র। কেউ নেই, চারপাশ ফাঁকা। দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিনিকলের যন্ত্রপাতিগুলোর রং বদলে গেছে। বেশির ভাগ নষ্ট হওয়ার উপক্রম। বিকল হয়ে পড়ে আছে আখ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলোসহ কয়েকটি ট্রাক। প্রায় ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর গড়ে তোলা রংপুরের একমাত্র ভারী শিল্পকারখানা এলাকাটি এখন যেন পোড়োবাড়ি (ভূতের বাড়ি)।

চিনিকলের ভেতরে পাতা কুড়ানো এক বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। নুরুল আমিন নামের এই ব্যক্তি তিন বছর আগে অবসরে গেছেন। শ্যামপুর চিনিকলের বোডিং হাউসের মেকানিক পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। এখন পর্যন্ত প্রভিডেন্ট ফান্ডের এক টাকাও পাননি। কবে নাগাদ পাবেন, তাও জানেন না। বর্তমানে চিনিকলে আখমাড়াই বন্ধ থাকায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন তিনি।

নুরুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিজের জায়গা-জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আখ চাষ করতাম। কিন্তু এখন চিনিকল বন্ধ থাকায় সেটাও আর করতে পারছি না। ভীষণ কষ্টে আছি, হাতে টাকাপয়সাও নেই। আমাদের মতো গরিব চাষিদের স্বার্থে সরকারের উচিত শ্যামপুর চিনিকল বাঁচিয়ে রাখা।’

স্থানীয় চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে চিনিকলটি লোকসানের মুখে পড়েছে। তাছাড়া আখের উৎপাদন হ্রাস এবং চিনিকলে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবকেও দুষছেন তারা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন করে বিনিয়োগ এবং কৃষিভিত্তিক বিকল্প শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথাও বলছেন কেউ কেউ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শ্যামপুর চিনিকলটি ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয়। ১৯৬৭-৬৮ সালে জাপানি কোম্পানি মিৎসুবিশি আখমাড়াই কার্যক্রম শুরু করে। তিন বছরেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। ১৯৭২ সালে চিনিকলটি জাতীয়করণ করার সময় বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ছিল ১০ হাজার টন। তখনো লাভের মুখই দেখত প্রতিষ্ঠানটি। বছরে তিন মাস চালু থাকত চিনিকলের মেশিন। কিন্তু প্রেক্ষাপট বদলের সঙ্গে সঙ্গে লাভের অঙ্ক উল্টো পথে হাঁটতে থাকে। ২০০০ সাল থেকে শুরু হয় ধারাবাহিক লোকসান।

চিনিকলের হিসাব শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে মিলটির লোকসান হয় ৬৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ মৌসুমে লোকসান হয় প্রায় ৬১ কোটি টাকা। আর গত ১০ মাড়াই মৌসুমে লোকসানের সঙ্গে যোগ হওয়া ব্যাংকঋণ, ঋণের সুদ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন খাত মিলে শেষ পর্যন্ত লোকসান বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০৫ কোটি টাকায়।

এ পরিস্থিতিতে শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি শ্যামপুর সুগার মিল ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের আরও ৫টি চিনিকল বন্ধের সুপারিশ করে। ২০২০-২১ মৌসুমে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন রংপুরের এই চিনিকলটিতে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।

চিনিকলে কর্মরত শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে উল্লেখ করে আহ্সান হাবিব বলেন, গত মৌসুমে এখানে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর এখানকার ৪৯৩ জনবল থেকে বিভিন্ন চিনিকলে ৩৮৯ জনকে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে হাই স্কুলেসহ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক রয়েছে মাত্র ১০৪ জন। গত বছরের জুন মাস থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। তা ছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ ৭ কোটি, গ্র্যাচুয়িটি বাবদ ১০ থেকে ১১ কোটি এবং বেতন বাবদ প্রায় চার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

কৃষিনির্ভর এই এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করে লাভজনক অবস্থানে নিতে পুনরায় চিনিকল চালুর দাবি জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। চিনিকলটি কৃষিনির্ভর উৎপাদনমুখী করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গত বছরের নভেম্বরে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কিছু প্রস্তাবও পাঠিয়েছেন তিনি।

প্রস্তাব প্রসঙ্গে আহ্সান হাবিব বলেন, চিনিকলটির নিজস্ব জায়গায় এক হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আলুর কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করা যেতে পারে। এটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ২০ কোটি টাকা হতে পারে। তবে কোল্ডস্টোরেজ করা গেলে বছরে এক থেকে দেড় কোটি লাভ করা সম্ভব। এ ছাড়া এখানে পিপি ব্যাগ ও চিনির প্যাকেট তৈরির কারখানা স্থাপন করলে বছরে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা লাভ হতে পারে। পাশাপাশি আলু, আম, ভুট্টা, ঘিরে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করা গেলে বার্ষিক কয়েক লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।

এনএ