বাগেরহাটে সরকারি মূল্যের কয়েক গুণ বেশি খাজনা আদায়
বাগেরহাটের বিভিন্ন হাট-বাজারে ইজারাদার ও খাজনা আদায়কারীদের দৌরাত্মে অসহায় হয়ে পড়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা। ভয়ভীতি দেখিয়ে সরকারি মূল্যের কয়েক গুণ বেশি খাজনা আদায় করছে ইজারাদাররা। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এ ছাড়া সরকারি খাজনার (টোল) মূল্য হাট-বাজারে প্রকাশ্যে টানানোর কথা থাকলেও জেলার বেশিরভাগ হাটে তা নেই।
বিভিন্ন হাটের ব্যবসায়ী ও পণ্য বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি রেট সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। খাজনা আদায়কারীরা যে পরিমাণ টাকা চায়, সেটায় দিতে হয়।
সরেজমিনে গত রোববার (৩ এপ্রিল) দুপুরে কচুয়া উপজেলার সব থেকে বড় বাজার বাধাল হাটে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি টোল নির্ধারণ করা কোনো মূল্য তালিকা নেই।
বিজ্ঞাপন
এই বাজারে খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতিটি গরু ক্রয়ের জন্য ক্রেতাকে ১০০০-১৫০০ টাকা, ছাগল বিক্রির জন্য ৯ টাকা, হাস-মুরগি ৭ টাকা, মাংসের দোকান-৩০০ টাকা, কাঁচামাল-সবজি বিক্রেতা চটি প্রতি ১২০-২০০ টাকা, তরমুজ ২৫০, কাপড় ৫০-৬০ টাকা, মশলা ৫০-৮০ টাকা, ভ্রাম্যমাণ খাদ্য পণ্য ৬০ টাকা, মাছ ১২০ টাকা, মিঠা ৫০ টাকা, বাশের তৈরি ঝুড়ি-ঝাকা-২০-৩০ টাকা, পান ২০০ টাকা, গুড় (মিঠা) ৫০ টাকা খাজনা প্রদান করতে হয়।
বিজ্ঞাপন
এর বাইরে পাইকারি ক্রয়-বিক্রয়েও প্রতি হাটে বিপুল পরিমাণ খাজনা তোলা হয়।
জেলা প্রশাসন নির্ধারিত সরকারি মূল্য অনুযায়ী ছাগল ক্রয়ের মূল্যে ৫ শতাংশ, মাংসের দোকান প্রতি ১০ টাকা, পান ৬ টাকা, মশলা ৭ টাকা, তরমুজ ও অন্যান্য ফল ৫ টাকা, গুড়-মিঠা ৬ টাকা, কাঁচামাল-সবজি ৬ টাকা, মশলা দোকান প্রতি ৭ টাকা রয়েছে। তবে সরকারি রেটের চেয়ে কয়েক গুন বেশি খাজনা আদায় করলেও ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না কেউ।
বাধাল বাজারের নিয়মিত কাঁচামাল ব্যবসায়ী রাজিব তালুকদার বলেন, ৩-৪ হাত জায়গায় ছালার চট বিছিয়ে বসলেই ১২০ টাকা দিতে হয়। অনেক সময় দুইশ টাকাও দিতে হয়। আর না দিলে বসতে দেওয়া হয় না। শুনেছি হাটে খাজনা দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি রেট রয়েছে। কিন্তু আমরা সরকারি রেট সম্পর্কে জানি না, কোনো দিন দেখিওনি।
পান ব্যবসায়ী অরুন কুমার সেন বলেন, আমরা শুনেছি পানের দোকানের ক্ষেত্রে সরকারি মূল্য এক হাটে ৬ টাকা। আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২০০ টাকা। কিন্তু এটা বলার কোনো জায়গা নেই। একটু কম নিতে বললে ইজারাদাররা আরও খারাপ ব্যবহার করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, সরকারি হাট-বাজারগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা ইজারা নেয়। ফলে তারা তাদের খুশিমত খাজনা আদায় করে। আমাদের মতো সাধারণ ব্যবসায়ীরা সরকারি রেট দেখার কথা বললে মার খেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসাও বন্ধ করে দিতে হয়।
দেখা গেছে, এই ঘটনা শুধু বাধাল বাজারে নয়, কচুয়া উপজেলার কচুয়া, সাইনবোর্ড, গজালিয়া, মোরেলগঞ্জের দৈবজ্ঞহাটি, কালিকাবাড়ি, সন্যাসি, মোরেলঞ্জ, সদর উপজেলার যাত্রাপুর, মাদরাসাবাজার, বাগেরহাট শহরের কাঁচা বাজারসহ জেলার ১৫৪টি হাটের বেশিরভাগ হাটেই একইভাবে বেশি খাজনা আদায় করা হয়।
এ ছাড়া একই পণ্যে বারবার খাজনা আদায়ের ঘটনাও রয়েছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাধাল বাজার ইজারাগ্রহণকারী নাজমা আক্তারের পক্ষে খাজনা আদায়কারী সরোয়ার হোসেন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি মূল্যের থেকে কম নেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে বেশি নেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা অনেক সময় মিথ্যা কথাও বলে আমাদের সাথে।
সরকার নির্ধারিত খাজনার রেট প্রকাশ্য স্থানে প্রদর্শণের বিষয়ে সরোয়ার হোসেন বলেন, এটা ইজারাদাররা টানায় না, এটা জেলা প্রশাসনের টানানোর কথা।
এ বিষয়ে বাগেরহাট প্রেস ক্লাবের সভাপতি নীহার রঞ্জন সাহা বলেন, হাট-বাজারে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের ফলে ভোক্তা পর্যায়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ বিষয়ে সরকারি তদারকিও নেই। গত ১৩ মার্চ জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সমাধান হয়নি। দ্রুত প্রতিটি হাটে সরকার নির্ধারিত মূল্য টানিয়ে সহনীয় পর্যায়ে খাজনা নেওয়ার দাবি জানাই।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা করা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা প্রকাশ্য স্থানে টানানোর জন্য ইতোমধ্যে সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তানজীম আহমেদ/আরআই